ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর নীরবতা

২০২৫ সালের জুনে ইসরায়েলের বিস্ময়কর সামরিক হামলার পর ইরান ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত রাজনৈতিক মঞ্চে এ অবস্থায় ইরান একদম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। যদিও ইসরায়েলের এই হামলার বিরুদ্ধে কিছু আরব দেশ নিন্দা জানালেও, তাদের প্রকৃত অবস্থান এবং ইরানের প্রতি সহযোগিতার অভাব উদ্বেগজনক।
ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নিকটতম আঘাত ও আরব দেশগুলোর নীরবতা
ইসরায়েলের সামরিক হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইনসহ উপসাগরীয় দেশগুলো একটি নিন্দাবাণী দিয়েছিল। তবে, এই নিন্দা ছিল রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ এবং সাম্প্রতিক সংঘাতের গতি-প্রকৃতির ওপর কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, এই দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই ইরানের বর্তমান শাসকদের প্রতি অবিশ্বাসী।
সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েলের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন, তবে আমরা শান্তি চাই।” এ কথা বললেও তারা কোনও সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরির জন্য।
আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর দ্বিমুখী কূটনৈতিক কৌশল
এই অঞ্চলের দেশগুলো দুই দিক থেকে শঙ্কিত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও সামরিক ঘাঁটিগুলো তাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে বড় কোনো যুদ্ধে তাদের দেশগুলো ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। যুদ্ধের ফলে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বাণিজ্যপথের বিঘ্ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের বাধা এড়ানো তাদের প্রধান লক্ষ্য।
ফ্রেডরিখ এব্র্ট ফাউন্ডেশনের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মার্কাস স্নাইডার বলেন, “এই দেশগুলো জানে, বড় সংঘাত হলে তারা নিরাপদ থাকতে পারবে না।” তাই তারা ইসরায়েলকে সরাসরি আক্রমণ না করে কূটনৈতিক নিন্দায় সন্তুষ্ট।
তেহরানের শিথিল শক্তি ও মিত্রদের দুর্বল অবস্থা
ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিজবুল্লাহ, হুতিরা ও ইরাকি মিলিশিয়ারা এখন পূর্বের মতো শক্তিশালী নয়। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর যোদ্ধা ও নেতৃত্ব অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে গত বছরের সংঘাতের কারণে। ইয়েমেনের হুতিরা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালেও তাদের সামরিক সক্ষমতা পূর্বের মত নেই, যা যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের বায়ু হামলার কারণে কমে গেছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর ইরান সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করেছে, যার ফলে লেবাননে হিজবুল্লাহর অস্ত্র সরবরাহও প্রভাবিত হয়েছে।
সৌদি আরবের স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক মধ্যস্থতা
২০১৬ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর ২০২৪ সালে চীনের মধ্যস্থতায় পুনঃস্থাপিত সম্পর্ক সত্ত্বেও, সৌদি আরব এখন ঝুঁকি নেয় না। তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক সমাধানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। গাজা সংঘাতের সমাধানে বৃহৎ সম্মেলন আয়োজন করেছে তারা।
জার্মানির থিঙ্কট্যাংক কারপোর বিশেষজ্ঞ সেবাস্তিয়ান সন্স বলেন, “সৌদি আরব এখন ঝুঁকি নিতে চায় না, যুদ্ধ নয় কূটনৈতিক পথেই তারা বিশ্বাস করে।”
আব্রাহাম চুক্তি ও উপসাগরীয় দেশগুলোর নিরাপত্তা আগ্রহ
২০২০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তি সই করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো। সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশেরও এই চুক্তিতে যোগদানের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সৌদি আরবের এই চুক্তিতে যোগদানের আশঙ্কাতেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। উপসাগরীয় দেশগুলো এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি পেতে আগ্রহী। একইসাথে তারা ইরানকে নিজ দেশের জন্য বড় হুমকি মনে করে।
মধ্যপ্রাচ্যের পরবর্তী পরিস্থতি
বর্তমানে ইরান একদিকে ইসরায়েলের সামরিক আঘাতে দুর্বল, অন্যদিকে তার সহযোগী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আরব উপসাগরীয় দেশগুলো যদিও প্রকাশ্যে ইসরায়েলের নিন্দা জানাচ্ছে, কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চায় এবং ইরানকে দুর্বল দেখতে আগ্রহী।
কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, নিজস্ব নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে উপসাগরীয় দেশগুলো ‘নীরব প্রত্যক্ষদর্শীর’ ভূমিকায় রয়েছে। ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এই অঞ্চলের দেশগুলোর উপর নির্ভর করবে।