প্রযুক্তি

কম্পিউটারে আপলোড করা যাবে মানুষের মন

ছর দুয়েক আগেও এধরনের কথা শুনলে মানুষ হয়তো অবাক হতো কিংবা সরাসরি ‘সাই-ফাই’ গল্প বলে উড়িয়ে দিত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আজ বলছেন, ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ তার শরীরের অস্তিত্ব ছাড়াই কেবল ‘ডিজিটাল সত্ত্বা’ হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবে। এই ধারণার নাম—মাইন্ড আপলোডিং।

মাইন্ড আপলোডিং কী?

মাইন্ড আপলোডিং এমন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা, যেখানে মানুষের মস্তিষ্কের সব তথ্য—স্মৃতি, আবেগ, আত্মসচেতনতা, অনুভব এবং চিন্তার ধরণ—একটি সুপারকম্পিউটারে হুবহু কপি করে সংরক্ষণ করা হয়। এতে করে বাস্তব জগতে না থেকেও একজন ব্যক্তি ডিজিটাল দুনিয়ায় একটি নতুন রূপে চিরকাল টিকে থাকতে পারবেন। একে সহজভাবে বলা যেতে পারে—মানুষের মনকে কম্পিউটারে স্থানান্তর

ডিজিটাল সত্ত্বার জীবন কেমন হবে?

যিনি মাইন্ড আপলোডিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল রূপে অস্তিত্ব পাবেন, তিনি আর মাংস-পেশীর শরীরের অধিকারী হবেন না। কিন্তু তাঁর থাকবে নিজস্ব স্মৃতি ও আত্মপরিচয়। ডিজিটাল পৃথিবীতে তিনি খেতে পারবেন, গাড়ি চালাতে পারবেন, খেলাধুলাও করতে পারবেন, এমনকি দেয়ালের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা অন্য গ্রহে ভ্রমণের মতো ‘অসম্ভব’ কাজও করতে পারবেন। সেখানে একমাত্র সীমা হবে প্রযুক্তির সক্ষমতা

বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?

জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ডব্রোমির রাহনেভ মনে করেন, “তাত্ত্বিকভাবে মাইন্ড আপলোডিং সম্ভব।” যদিও বর্তমান বিজ্ঞানে এই প্রযুক্তি এখনো বাস্তবতার অনেক বাইরে, তবুও তিনি বলেন, “চাঁদে মানুষ পাঠানো বা মানব জিনোমের রহস্য উন্মোচনের মতো অসম্ভব কাজগুলো আমরা আগেই সফলভাবে করেছি।”

তাঁর মতে, এই শতাব্দীর মধ্যে মাইন্ড আপলোডিং সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন না, তবে ২০০ বছরের মধ্যে তা হতে পারে। এমনকি তিনি আশাবাদী যে, যে ব্যক্তি একদিন চিরজীবী হবে, সে হয়তো এখনই জন্ম নিচ্ছে

মস্তিষ্ক কেন এত জটিল?

মানব মস্তিষ্ককে বলা হয়, “পরিচিত মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল বস্তু”। প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন এবং তাদের অসংখ্য সংযোগ নিয়ে গঠিত এই জৈব কম্পিউটারকে পুরোপুরি অনুকরণ করা বিজ্ঞানের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কেবল একটি মাছির সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক এবং একটি ইঁদুরের সামান্য অংশ স্ক্যান করতে পেরেছেন। মানুষের মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ ত্রিমাত্রিক স্ক্যান ও ম্যাপিংয়ের জন্য প্রয়োজন এমন এক প্রযুক্তি—যা এখনো বাস্তবে তৈরি হয়নি।

ইন্দ্রিয়বোধের প্রয়োজনীয়তা

কম্পিউটারে মস্তিষ্ক আপলোড করা গেলেও, সেটি চোখ, কান, ঘ্রাণ, স্পর্শ, ব্যথাবোধ ইত্যাদি অনুভূতির অভিজ্ঞতা চায়। এসব ইন্দ্রিয়ের অভাবে ‘ডিজিটাল সত্ত্বা’ এক ধরনের ‘সেন্সরি ডিপ্রাইভেশন’-এ ভোগতে পারে, যা মানসিক যন্ত্রণা ও বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে।

তাই, সফল মাইন্ড আপলোডিংয়ের জন্য শুধু মন নয়, তাকে ঘিরে থাকা অনুভব ও অভিজ্ঞতার ডিজিটাল পুনর্নির্মাণও অত্যাবশ্যক। সামান্য ভুলেও একজন ব্যক্তি মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হতে পারেন।

কোন পথে এগোচ্ছে বিজ্ঞান?

বিজ্ঞানীরা কয়েকটি পথ চিন্তা করছেন:

  1. সুপার স্ক্যানিং ও ম্যাপিং পদ্ধতি:
    প্রতিটি নিউরন স্ক্যান করে কম্পিউটারে পুনর্নির্মাণ করা।
  2. কৃত্রিম নিউরনে রূপান্তর:
    একে একে প্রতিটি বাস্তব নিউরনকে কৃত্রিম নিউরনে রূপান্তর করা। তবে এখনো একটি বাস্তব নিউরনও সফলভাবে কৃত্রিমে রূপান্তর করা সম্ভব হয়নি।
  3. চিন্তার কাঠামো অনুকরণ:
    মস্তিষ্কের সকল নিউরন না স্ক্যান করেও কেবল চিন্তার কাঠামো অনুকরণ করে মডেল তৈরি করা। যেমন—গাড়ি কীভাবে কাজ করে বুঝলে সেটি তৈরি করা সহজ হয়।

কীভাবে মানুষের চিন্তা তৈরি হয়, সেটা কি আমরা জানি?

এটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। কয়েক হাজার বা লাখ নিউরন মিলে কীভাবে চিন্তা বা চেতনা তৈরি করে, তার রহস্য এখনো অজানা। এ কারণেই পুরো মস্তিষ্কের নকশা তৈরি বা ডিজিটাল রূপ দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বারবার বাধার মুখে পড়ছেন।

২০৪৫ না ২২০০?

কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, ২০৪৫ সালের মধ্যেই মাইন্ড আপলোডিং সম্ভব হবে। আবার অনেকে বলেন, এটি এই শতকের শেষেও অসম্ভব। রাহনেভ বলেন, “আমি বিশ্বাস করি না এটি এই শতকের মধ্যেই হবে। সম্ভবত আগামী ২০০ বছরের মধ্যে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।”

তবে এটুকু নিশ্চিত যে, যদি এটি একবার সম্ভব হয়—তাহলে মানুষ নিজেকে চিরজীবী করার নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটাবে।

বিলিয়নিয়ারদের উৎসাহ ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি

মাইন্ড আপলোডিং নিয়ে সবচেয়ে উৎসাহী হচ্ছেন বিলিয়নিয়ার প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তারা। অনেকেই কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত, শুধু চিরজীবী হওয়া বা মৃত্যুকে পরাজিত করার আশায়। কম্পিউটিং শক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে—আগামী ৫০ বছরেই অনেক অবাক করা প্রযুক্তি সামনে আসতে পারে।

মাইন্ড আপলোডিং এখনো স্বপ্নের মতো শোনালেও এটি আর শুধুই কল্পবিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান বলছে, এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, এবং ভবিষ্যতের কোনো এক সময় হয়তো মানুষ কম্পিউটারের মধ্যে চিরজীবী হয়ে বেঁচে থাকবে। প্রযুক্তির অগ্রগতির গতিতে যদি কোনো বড় বাঁধা না আসে, তাহলে হয়তো আমাদেরই ভবিষ্যত প্রজন্ম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘দেহহীন মানুষের’ দেখা পাবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button