প্রযুক্তি

সৌরজগতের বাইরের গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র: কত দূরে তারা

আমাদের সৌরজগত মহাবিশ্বের এক ছোট্ট কোণায় অবস্থিত। সৌরজগতের বাইরেও রয়েছে অগণিত নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি, যাদের দূরত্ব এতটাই বেশি যে, তা পরিমাপ করতে এককের প্রয়োজন হয় ‘আলোকবর্ষ’-এর। এই বিশাল দূরত্ব পরিমাপের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আশ্রয় নেন। চলুন জেনে নিই এই দূরবর্তী গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রগুলো সম্পর্কে এবং বিজ্ঞানীরা কীভাবে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করেন।

মহাবিশ্ব ও সৌরজগতের অবস্থান

আমাদের সৌরজগতটি মিল্কিওয়ে (Milky Way) নামক গ্যালাক্সির অন্তর্ভুক্ত। এই গ্যালাক্সিতে প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। মিল্কিওয়ে নিজেই একটি সর্পিল গঠনের গ্যালাক্সি যা প্রায় ১ লাখ আলোকবর্ষ চওড়া। কিন্তু মিল্কিওয়ের বাইরেও মহাবিশ্বে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, যাদের মধ্যে অনেকগুলো আমাদের থেকে কয়েক মিলিয়ন বা এমনকি কয়েকশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।

দূরত্ব পরিমাপ: কীভাবে জানা হয়?

পৃথিবী থেকে এই বিশাল গ্যালাক্সিগুলোর দূরত্ব নির্ণয় করা সহজ নয়। এজন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যেগুলো দীর্ঘ গবেষণার ফল।

সেফেইড নক্ষত্র (Cepheid Stars) পদ্ধতি

সেফেইড নক্ষত্র এমন একধরনের পালসেটিং নক্ষত্র যাদের উজ্জ্বলতা নির্দিষ্ট সময় পরপর পরিবর্তিত হয়। এই উজ্জ্বলতার পরিবর্তনের সময়কাল তাদের প্রকৃত উজ্জ্বলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা প্রথমে সেফেইড নক্ষত্র শনাক্ত করেন, তারপর তার উজ্জ্বলতার তথ্য বিশ্লেষণ করে গ্যালাক্সির দূরত্ব হিসাব করেন।

টাইপ আইএ সুপারনোভা (Type Ia Supernova)

এই ধরনের সুপারনোভা সাধারণত নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতায় বিস্ফোরিত হয়। তাই একে ‘স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল’ হিসেবে ধরা হয়। দূরবর্তী গ্যালাক্সিতে যদি টাইপ আইএ সুপারনোভা দেখা যায়, তাহলে তার উজ্জ্বলতা বিশ্লেষণ করে সেই গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয় করা যায়।

টালি-ফিশার রিলেশন (Tully-Fisher Relation)

সর্পিল গ্যালাক্সির ঘূর্ণনের গতি তার উজ্জ্বলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঘূর্ণনের পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সির মোট উজ্জ্বলতা বের করেন এবং সেটার ভিত্তিতে দূরত্ব নির্ধারণ করেন।

হাবল রুল (Hubble’s Law)

হাবল সূত্র অনুযায়ী, একটি গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে যত দূরে অবস্থান করে, তা তত বেশি দ্রুতি নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। এই দ্রুতি ও রেডশিফট পরিমাপের মাধ্যমে গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়।

আলোকবর্ষ: দূরত্ব পরিমাপের একক

আলোকবর্ষ হলো একটি বিশেষ দূরত্ব একক, যা বোঝায় যে আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে, সেটিই এক আলোকবর্ষ। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার বেগে চলে, ফলে এক বছরে এটি প্রায় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। এই বিশাল এককই ব্যবহার করা হয় মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের দূরত্ব বোঝাতে।

কিছু পরিচিত গ্যালাক্সির দূরত্ব

অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি (Andromeda Galaxy)

এই গ্যালাক্সি আমাদের নিকটতম বৃহৎ গ্যালাক্সি এবং এটি আমাদের মিল্কিওয়ের সঙ্গে ভবিষ্যতে সংঘর্ষেও জড়াবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এটি পৃথিবী থেকে ২৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ আলোর গতিতে ভ্রমণ করলেও সেখানে পৌঁছাতে ২৫ লাখ বছর সময় লাগবে।

ট্রায়াঙ্গুলাম গ্যালাক্সি (Triangulum Galaxy)

প্রায় ৩০ লাখ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্যালাক্সিটি স্থানীয় গ্যালাক্সি গ্রুপের অংশ।

লার্জ ম্যাগেলানিক ক্লাউড (Large Magellanic Cloud)

এই ক্ষুদ্র উপগ্যালাক্সিটি আমাদের মিল্কিওয়ের ঘূর্ণনক্ষেত্রের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর দূরত্ব ১ লাখ ৬৩ হাজার আলোকবর্ষ

স্মল ম্যাগেলানিক ক্লাউড (Small Magellanic Cloud)

এটি ২ লাখ ৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত, যা পৃথিবী থেকে আলোর গতিতে গিয়েও পৌঁছাতে বিশাল সময় লাগবে।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র

আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে। সেই কেন্দ্র আমাদের থেকে প্রায় ২৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে।

আরও কিছু দূরবর্তী গ্যালাক্সি

গ্যালাক্সির নামদূরত্ব (আলোকবর্ষ)
সেন্টোরাস এ (Centaurus A)১ কোটি ১০ লাখ – ১৬ লাখ
বোডেস গ্যালাক্সি (Bode’s)১ কোটি ১২ লাখ ১২ হাজার
পিনহুইল গ্যালাক্সি (Pinwheel)২ কোটি ১০ লাখ
ব্ল্যাক আই গ্যালাক্সি (Black Eye)১ কোটি ৭ লাখ
সোম্বেরো গ্যালাক্সি (Sombrero)২ কোটি ৯০ লাখ

এই সব গ্যালাক্সি এতটাই দূরে যে বর্তমান প্রযুক্তিতে তাদের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দূরত্ব নির্ণয় করে আমরা এই মহাবিশ্বের গঠন ও বিস্তার সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি।

ভবিষ্যতের গবেষণার দিগন্ত

বর্তমানে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা আরও দূরের গ্যালাক্সির ছবি তুলতে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। এমনকি বিগ ব্যাং-এর পর খুব কাছাকাছি সময়ে গঠিত প্রাচীন গ্যালাক্সিও আবিষ্কৃত হচ্ছে।

আমাদের সৌরজগত মহাবিশ্বের বিশালতায় এক বিন্দুরও কম। গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব বোঝা মানেই মহাবিশ্বকে বোঝার পথে একটি বিশাল অগ্রগতি। সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে এই গবেষণা আমাদের আরও নতুন দিগন্তের সন্ধান দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button