প্রযুক্তি

২০৩০ সালে ই-সিম ব্যবহারকারী হবে ৪৫০ কোটি

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির ধারাবাহিক অগ্রগতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ই-সিম প্রযুক্তি সামনে এসেছে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। ক্যালেইডো ইন্টেলিজেন্সের সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ই-সিম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৫০ কোটিতে পৌঁছাবে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় নয় গুণ বেশি। এই প্রযুক্তি শুধু স্মার্টফোন ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্মার্টওয়াচ, ট্যাবলেট এবং ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) ডিভাইসেও এর ব্যবহার বাড়ছে।

ই-সিম কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?

ই-সিম বা ইলেকট্রনিক সিম হচ্ছে একটি ডিজিটাল সিম কার্ড যা সরাসরি ডিভাইসের মাদারবোর্ডে সংযুক্ত থাকে। এটি ফিজিক্যাল সিম কার্ডের বিকল্প হিসেবে কাজ করে, ফলে ব্যবহারকারীকে আর প্লাস্টিক সিম কার্ড বহন করতে হয় না। মোবাইল নম্বর পরিবর্তন, নতুন অপারেটর যুক্ত করা, বা ডিভাইস পরিবর্তন সবকিছুই করা যায় অনলাইনভিত্তিক একটি সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা পায় ঝামেলাবিহীন অভিজ্ঞতা এবং অপারেটর পরিবর্তন করা হয় আরও দ্রুত। পাশাপাশি এটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবেও স্বীকৃত, কারণ ফিজিক্যাল সিমের উৎপাদন ও পরিবহন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয় প্রচুর প্লাস্টিক এবং শক্তি, যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ই-সিম প্রযুক্তির ব্যবহার

২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে যেখানে মাত্র ৫০ কোটি ডিভাইসে ই-সিম ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেখানে গবেষণা বলছে যে এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ কোটিতে উন্নীত হবে। এটি বছরে গড়ে প্রায় ৮০ কোটি নতুন ই-সিম সংযুক্ত ডিভাইসের বৃদ্ধি নির্দেশ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিস্ময়কর বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ:

  1. ফাইভজি নেটওয়ার্কের বিস্তার: ই-সিম প্রযুক্তি ফাইভজি ইকোসিস্টেমের সাথে অসাধারণভাবে মানানসই। দ্রুতগতির ডেটা সংযোগ ও নিরবিচারে কানেকটিভিটি নিশ্চিত করে ফাইভজি, যা ই-সিম ব্যবহারে আরও কার্যকর।
  2. স্মার্ট ডিভাইসের জনপ্রিয়তা: স্মার্টফোন ছাড়াও এখন স্মার্টওয়াচ, স্মার্টগ্লাস, হেলথ ট্র্যাকার, গাড়ির সেন্সরসহ নানান ধরনের IoT ডিভাইসে ই-সিম ব্যবহৃত হচ্ছে।
  3. নিরাপত্তা ও নমনীয়তা: ই-সিম প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ডেটা সুরক্ষিতভাবে সংরক্ষিত থাকে এবং অপারেটর পরিবর্তন বা তথ্য স্থানান্তর অত্যন্ত সহজভাবে করা যায়।

চীনে বিধিনিষেধ শিথিল: ই-সিম বিস্তারের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল

প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বড় বাজার চীনে ই-সিম ব্যবহারে দীর্ঘদিন যাবত কিছু বিধিনিষেধ ছিল। তবে সম্প্রতি চীন সরকার এই সীমাবদ্ধতা শিথিল করেছে। এতে করে ২০২৫ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ই-সিম চালিত স্মার্টফোন বাজারে আসার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের মতো একটি বড় বাজারে ই-সিম প্রযুক্তির প্রসার ঘটলে বিশ্বজুড়ে এর জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।

বিশেষ করে হুয়াওয়ে, শাওমি, অপ্পো, ভিভোসহ অন্যান্য চীনা মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই ই-সিম প্রযুক্তি যুক্ত ডিভাইস তৈরি শুরু করেছে। এটি চীনা বাজারে ই-সিমের দ্রুত বিস্তার নিশ্চিত করবে এবং অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়বে।

পরিবেশগত দিক থেকে ই-সিমের অবদান

বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ দূষণ অন্যতম প্রধান সমস্যা। প্রযুক্তি খাতে প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি বড় অংশ আসে ফিজিক্যাল সিম কার্ড থেকে। প্রতি বছর কোটি কোটি প্লাস্টিক সিম কার্ড উৎপাদিত হয় এবং এর বেশিরভাগই ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত অবস্থায় পরিবেশে থেকে যায়।

ই-সিম প্রযুক্তি প্লাস্টিক সিমের বিকল্প হিসেবে কাজ করে, যার ফলে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে ই-সিম প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ছে।

মোবাইল অপারেটরদের প্রস্তুতি

বিশ্বের শীর্ষ মোবাইল অপারেটরগুলো ই-সিম সেবা চালু করেছে এবং ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির জন্য আলাদা প্ল্যাটফর্ম ও অবকাঠামো গড়ে তুলছে। যেমন:

  • AT&T, Verizon ও T-Mobile ইতোমধ্যেই ই-সিম সমর্থিত পরিষেবা চালু করেছে।
  • ভারতের Airtel ও Jio ই-সিম পরিষেবা দিচ্ছে বিভিন্ন হাই-এন্ড স্মার্টফোনে।
  • বাংলাদেশেও গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক ধীরে ধীরে ই-সিম পরিষেবা সম্প্রসারণে কাজ করছে।

বাংলাদেশে ই-সিম প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও ভবিষ্যতে এটি দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি: আরও টেকসই ও স্মার্ট সংযোগ

বিশ্বব্যাপী ই-সিম প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার যে শুধু প্রযুক্তিগত সুবিধা আনবে তা নয়, এটি একটি টেকসই ডিজিটাল সংযোগ ব্যবস্থার দিকেও ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে স্মার্ট হোম ডিভাইস, স্বয়ংচালিত যানবাহন, হেলথ ডিভাইস ইত্যাদি সবখানেই ই-সিমের সহজ সংযোগ প্রযুক্তির দরজা খুলে দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দশকে মোবাইল কানেকটিভিটি, অপারেটর নমনীয়তা, আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা এবং ডিভাইস ইন্টিগ্রেশনের ক্ষেত্রে ই-সিম এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। একই সঙ্গে এটি হবে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিভিত্তিক একটি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ।

উপসংহার:
ই-সিম প্রযুক্তি আজ আর ভবিষ্যতের একটি কল্পনা নয়, বরং এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তবতা। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ কোটিরও বেশি ই-সিম সংযুক্ত ডিভাইসের সম্ভাবনা প্রমাণ করে, প্রযুক্তির এই রূপান্তর কেবল শুরু মাত্র। উন্নত কানেকটিভিটি, পরিবেশবান্ধব চিন্তাভাবনা এবং ব্যবহারকারীর সুবিধা এই প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিচ্ছে এক নতুন দিগন্তের দিকে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button