টেলিগ্রাম অ্যাপ নিষিদ্ধ করছে ভিয়েতনাম

জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভিয়েতনাম। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তদন্তে সহযোগিতা না করার অভিযোগ এনে এই পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। আল জাজিরা’র শনিবারের (২৪ মে) এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। এই সিদ্ধান্ত টেলিযোগাযোগ খাতে ভিয়েতনামের কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয় এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২১ মে ভিয়েতনামের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় দেশের ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায়। এই চিঠিতে টেলিগ্রামকে আইন লঙ্ঘনের জন্য সতর্ক করা হয় এবং অ্যাপটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে আগামী ২ জুনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভিয়েতনামের সরকার দাবি করেছে যে, টেলিগ্রামের কিছু গ্রুপ ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রির কাজে অ্যাপটি ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে মাদক পাচার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগও আনা হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় স্পষ্ট জানিয়েছে যে, ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের ভিয়েতনামে টেলিগ্রামের কার্যক্রম বন্ধ করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ভিয়েতনাম সরকার তার নাগরিকদের সুরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
ভিয়েতনাম সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ৯ হাজার ৬০০ টেলিগ্রাম চ্যানেলের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ চ্যানেলই “খারাপ তথ্য” প্রচার করে। এর মধ্যে লাখ লাখ সদস্যের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলো “রাষ্ট্রবিরোধী” নথি এবং তথ্য প্রচারের কাজে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই ধরনের কার্যকলাপ দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে বলে সরকার মনে করে।
টেলিগ্রাম নিষিদ্ধের পেছনের কারণ:
ভিয়েতনামের টেলিগ্রাম নিষিদ্ধ করার পেছনে বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে:
১. অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা না করা: টেলিগ্রাম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে মাদক পাচার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিষয়ে তদন্তে ভিয়েতনামের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে না। এই অসহযোগিতা ভিয়েতনামের আইনশৃঙ্খলার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. ব্যবহারকারীর তথ্য অপব্যবহার: সরকারের দাবি অনুযায়ী, টেলিগ্রামের কিছু গ্রুপ ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি এবং অপব্যবহারের কাজে জড়িত। এটি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।
৩. রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ: ভিয়েতনামের সরকার মনে করে যে, টেলিগ্রামের অনেক চ্যানেল এবং গ্রুপ রাষ্ট্রবিরোধী তথ্য ও নথি প্রচার করছে। এই ধরনের প্রচার দেশের সামাজিক সংহতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করতে পারে। ভিয়েতনাম একটি একদলীয় শাসনব্যবস্থা এবং সরকার তার নাগরিকদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়, বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে।
৪. তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ: ভিয়েতনামের সরকার দীর্ঘকাল ধরে ইন্টারনেটে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে আসছে। এটি সরকারের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, তারা তাদের নাগরিকদের কাছে কোন তথ্য পৌঁছাবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। টেলিগ্রামের মতো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলো এই নিয়ন্ত্রণকে কঠিন করে তোলে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
ভিয়েতনামের এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশের জন্য একটি নজির সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে সরকারগুলো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বিভিন্ন দেশে সরকার এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলির মধ্যে তথ্যের অ্যাক্সেস এবং ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে।
বিভিন্ন দেশেই এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপগুলির বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। ভারত, চীন, রাশিয়া এবং ইরান সহ অনেক দেশেই এই ধরনের প্ল্যাটফর্মগুলির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার চেষ্টা চলছে। ভিয়েতনামের এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল স্বাধীনতার উপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের একটি উদাহরণ।
ভিয়েতনামের টেলিযোগাযোগ নীতি:
ভিয়েতনাম তার টেলিযোগাযোগ নীতিতে অত্যন্ত কঠোর। দেশটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের উপর ব্যাপক নজরদারি চালায় এবং কঠোর সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করে। ভিয়েতনামের সরকার অনলাইনে যেকোনো ধরনের ভিন্নমত বা সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণু। এই প্রেক্ষাপটে, টেলিগ্রামের মতো একটি প্ল্যাটফর্ম, যা এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন প্রদান করে এবং ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করে, সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব:
টেলিগ্রাম নিষিদ্ধের ফলে ভিয়েতনামের নাগরিকদের মধ্যে অনলাইন যোগাযোগের পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। অনেকেই বিকল্প মেসেজিং অ্যাপসের দিকে ঝুঁকতে পারেন। তবে, এসব বিকল্প অ্যাপসের উপরও ভবিষ্যতে ভিয়েতনামের সরকার নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে।
এই সিদ্ধান্ত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির জন্য একটি সতর্কবার্তা যে, তারা যদি স্থানীয় আইনের সাথে সহযোগিতা না করে, তবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। এটি ভিয়েতনামের ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি বড় প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ অনেক ব্যবসা এবং ব্যক্তি যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রাম ব্যবহার করত।
সবশেষে, ভিয়েতনামের টেলিগ্রাম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন জাতীয় নিরাপত্তা এবং অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন, তেমনই অন্যদিকে এটি ডিজিটাল স্বাধীনতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের উপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের একটি উদাহরণ। এই পদক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভিয়েতনামের সমাজ এবং অর্থনীতিতে কী রকম হবে তা সময়ই বলে দেবে।