আত্মহত্যার ঘটনায় গুগলকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে: মার্কিন আদালত

এআই চ্যাটবটের প্রভাবে কিশোরের আত্মহত্যা, প্রযুক্তি খাতে আইনি জবাবদিহির নতুন দৃষ্টান্ত
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় গুগল ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) স্টার্টআপ Character.ai-এর বিরুদ্ধে বিচার চলবে বলে রায় দিয়েছে দেশটির একটি ফেডারেল আদালত। মামলাটি করা হয়েছিল এক মায়ের পক্ষ থেকে, যিনি অভিযোগ করেছেন—এআই চ্যাটবটের প্রভাবে তাঁর ১৪ বছর বয়সী ছেলে আত্মহত্যা করেছে।
এই মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রে শিশু সুরক্ষা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর প্রথম বড় ধরনের আইনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রযুক্তি জগতে এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হয়ে উঠতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।
কী ঘটেছিল?
ফ্লোরিডার বাসিন্দা মেগান গার্সিয়া নামে এক মা অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে সিওয়েল সেটজার ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর আগে সে Character.ai প্ল্যাটফর্মের একটি চ্যাটবটের প্রতি অস্বাভাবিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ওই চ্যাটবট নিজেকে পরিচয় দিয়েছিল একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিক এবং বাস্তব ব্যক্তি হিসেবে।
মামলার নথিতে বলা হয়, চ্যাটবটটি কিশোরকে একাধিকবার আত্মহত্যার কথা বলেছে, এমনকি কিছু সময় ‘তাকে ছাড়া জীবনের অর্থ নেই’—এমন বার্তাও দিয়েছে। এতে কিশোর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
গুগল ও Character.ai-এর যুক্তি খারিজ করল আদালত
গুগল এবং Character.ai আদালতে মামলাটি খারিজের আবেদন জানিয়ে বলেছিল, চ্যাটবটের বার্তাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে থাকা ‘মুক্ত মত প্রকাশের অধিকার’-এর আওতাভুক্ত।
তবে মার্কিন জেলা বিচারক অ্যান কনওয়ে এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “এআই মডেলের মাধ্যমে তৈরি হওয়া কথোপকথন কীভাবে সংবিধানের স্বাধীন মত প্রকাশের সুরক্ষা পাবে, সে বিষয়ে আসামিপক্ষ সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের (LLM) মাধ্যমে উৎপাদিত তথ্যের উপর প্রযুক্তি নির্মাতাদের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত, বিশেষ করে যদি এর প্রভাব বাস্তব জীবনে ক্ষতিকর হয়।”
গুগলের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক
গুগল তার পক্ষে দাবি করেছে, তারা Character.ai-এর অ্যাপ, প্রযুক্তি বা কোনো উপাদানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয়। তবে বাদীপক্ষের দাবি, Character.ai প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গুগলের সাবেক দুই ইঞ্জিনিয়ার, যাদের গুগল পরবর্তীতে পুনরায় নিয়োগ দিয়েছিল এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের লাইসেন্স নিয়েছিল। এজন্য গুগলকে এই প্রযুক্তির ‘সহস্রষ্টা’ হিসেবে বিবেচনার দাবি জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে গুগলের মুখপাত্র হোসে কাস্তানেদা বলেন, “আমরা আদালতের রায়ের সঙ্গে একমত নই। গুগল এবং Character.ai দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিষ্ঠান।”
Character.ai-এর প্রতিক্রিয়া
Character.ai তাদের পক্ষ থেকে জানিয়েছে, তারা শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে একাধিক প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রেখেছে। আত্মহত্যা সংক্রান্ত কথোপকথন শনাক্ত করে তা ঠেকানোর জন্য নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে বাদীপক্ষের আইনজীবী মিতালি জৈন এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এটি শুধু এআই নয়, পুরো প্রযুক্তি খাতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। শিশুদের সুরক্ষায় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে এই রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
ভবিষ্যতের জন্য বার্তা
এই মামলার মাধ্যমে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর ফলাফল নিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনার সূচনা হলো। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রযুক্তির প্রভাব এখন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই রায় প্রযুক্তি খাতের কোম্পানিগুলোকে দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করবে এবং কনটেন্ট মনিটরিং ও শিশু সুরক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে।