প্রযুক্তি

ব্যান্ডউইথ নিরাপত্তায় হুমকি: অনিয়মে জর্জরিত ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স

বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ‘ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশনস’। সরকারি লাইসেন্সের অপব্যবহার, কোটি কোটি টাকার বকেয়া, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সুবিধা আদায়, আর আইএসপি সেবায় নীতিমালার চরম লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটি এখন টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য এক বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আর্থিক দুর্বলতা নয়—এই প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি এখন জাতীয় ব্যান্ডউইথ নিরাপত্তাকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা হারানোর পাশাপাশি, গ্রাহকসেবার মান এবং দেশের কৌশলগত তথ্য সুরক্ষাও এখন প্রশ্নের মুখে।

রাজস্ব ফাঁকি ও লাইসেন্স বাণিজ্য

সরকারি সূত্র ও সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণে জানা যায়, বিটিআরসি, বিএসসিসিএল, এয়ারটেল ও টাটার মতো ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সের বকেয়ার পরিমাণ ২৩ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে শুধু বিটিআরসির পাওনা প্রায় ৪ কোটি টাকা এবং বিএসসিসিএল-এর পাওনা ১ কোটির বেশি। শীর্ষ ব্যান্ডউইথ কোম্পানি এয়ারটেলের দাবি করা বকেয়া ১৩ কোটি টাকা এবং টাটার বকেয়া ৫ কোটি টাকা।

এই পাওনাগুলো পরিশোধ না করেই ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স একের পর এক সরকারি অনুমোদন ও এনওসি আদায় করেছে, যা নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

আদালতের রায়, তবুও কার্যকর নয়

বকেয়া আদায়ে বারবার তাগিদ দিলেও সাড়া না পেয়ে বিএসসিসিএল ঢাকা জেলা জজ আদালতে একটি আরবিট্রেশন মামলা দায়ের করে এবং তাতে জয়ী হয়। পরে সেই রায় কার্যকর করতে তারা ‘অ্যাওয়ার্ড এক্সিকিউশন মামলা’ও করে, যা এখনো বিচারাধীন।

সূত্র জানায়, ওয়ান এশিয়ার উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক লবিং এবং প্রশাসনিক মহলে প্রভাব খাটিয়ে এই মামলা এবং এনওসি বাতিলের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে পুনরায় এনওসি সংগ্রহ করেছে।

আইআইজি, আইটিসি ও আইজিডব্লিউ লাইসেন্সের অপব্যবহার

প্রথমদিকে আইআইজি, আইটিসি ও আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নিয়ে টেলিকম সেক্টরে প্রবেশ করলেও, ওয়ান এশিয়া সময়ের সঙ্গে নীতিমালা লঙ্ঘন করে একাধিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে।

প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন বেঙ্গল ব্রডব্যান্ড ২০১৬ সালে ডিভিশনাল আইএসপি লাইসেন্স পেলেও বর্তমানে তা নবায়ন না করেই অবৈধভাবে সেবা দিচ্ছে। অন্যদিকে এর আরেকটি শাখা প্রিজমা ডিজিটাল নেটওয়ার্ক একটি ন্যাশন ওয়াইড আইএসপি লাইসেন্স নিয়ে পরিচালিত হলেও তার কার্যক্রমও রয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।

গ্রাহক সেবা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে

আইএসপিএবি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ)-এর সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, “আইএসপি খাতের সেবা নির্ভর করে আইআইজি ও ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারীদের ওপর। কেউ যদি কোটি কোটি টাকা বকেয়া রেখে বাজারে অনিয়ম করে, তাহলে তা গ্রাহক সেবায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একই সঙ্গে এটি নেটওয়ার্ক নিরাপত্তারও জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।”

তিনি আরও বলেন, “নীতিগত বা কাঠামোগত সমস্যার দিকটিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত, তবে তার মানে এই নয় যে অনিয়মকারীদের ছাড় দেওয়া যায়।”

প্রশাসনিক মন্তব্য: ছাড় দেওয়া হবে না

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব বলেন, “সরকার চায়, ব্যবসায়ীরা সুষ্ঠুভাবে কাজ করুক এবং জনগণ যেন গুণগত সেবা পায়। কিন্তু কেউ যদি সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেয়, নিয়ম ভঙ্গ করে চলতে থাকে, তবে তাকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।”

বিটিআরসির অবস্থান

বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সকে এনওসি দেওয়ার শর্ত ছিল যে তারা ৫০ শতাংশ বকেয়া এককালীন পরিশোধ করবে এবং বাকি অংশ কিস্তিতে। ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এককালীন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।”

অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি শর্ত পূরণ করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

টিআইবির দৃষ্টিকোণ

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যেকোনো টেলিকম প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান রাজস্ব বকেয়া কিংবা নীতিগত ব্যত্যয় ঘটায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান হওয়া জরুরি।”

মূল প্রশ্ন: নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসায় কি ভবিষ্যৎ আছে?

ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ উঠেছে, তা শুধু আর্থিক অনিয়মেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ইন্টারনেট নিরাপত্তা, কনজিউমার রাইটস এবং ন্যাশনাল সাইবার রেজিলিয়েন্সের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত দায়বদ্ধতার আওতায় না আনা হলে তা ভবিষ্যতে দেশের সাইবার নিরাপত্তা, টেলিকম খাতের বিনিয়োগ আস্থা এবং ইন্টারনেট সেবা মানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

সারাংশ:

  • ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ।
  • লাইসেন্স পাওয়া ও নবায়নে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রমাণ।
  • বকেয়া আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
  • গ্রাহক সেবা ও ব্যান্ডউইথ নিরাপত্তা হুমকিতে।
  • সরকারি কর্মকর্তা, বিটিআরসি ও টিআইবি সবাই বিষয়টিকে গুরুতর মনে করছেন।
মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button