বাংলাদেশে স্টারলিংকের যাত্রা শুরু, মাসে ৪২০০ টাকায় মিলবে উচ্চগতির ইন্টারনেট

বিশ্ববিখ্যাত স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক অবশেষে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে। মার্কিন ধনকুবের এলন মাস্কের মালিকানাধীন এই প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠানটি মঙ্গলবার (২০ মে ২০২৫) সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ এ ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হলো, যেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও পাওয়া যাবে আনলিমিটেড উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।
এই খবর নিশ্চিত করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি জানান, সোমবার বিকেলে স্টারলিংকের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা ফোনে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের তথ্য দেন এবং পরদিন সকালে তা প্রকাশ করা হয়।
স্টারলিংক কী এবং এটি কিভাবে কাজ করে?
স্টারলিংক হলো স্পেসএক্স-এর একটি প্রকল্প, যা পৃথিবীপৃষ্ঠের যেকোনো প্রান্তে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি পৃথিবীর কক্ষপথে উৎক্ষেপণকৃত হাজার হাজার নিম্ন-কক্ষপথ (LEO) স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। গ্রাহকের বাড়িতে বসানো হয় একটি বিশেষ ডিশ ও রাউটার, যা সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত থেকে ইন্টারনেট সরবরাহ করে।
এর ফলে কোনো ফাইবার অপটিক কেবলের প্রয়োজন হয় না, এবং এমন এলাকাগুলোতেও এই ইন্টারনেট পৌঁছে যায় যেখানে সাধারণ ব্রডব্যান্ড পরিষেবা অনুপলব্ধ বা দুর্বল।
বাংলাদেশে চালু হওয়া প্যাকেজ ও মূল্য বিবরণী
প্রথম পর্যায়ে স্টারলিংক বাংলাদেশে দুটি রেসিডেনশিয়াল প্যাকেজ চালু করেছে:
- স্টারলিংক রেসিডেন্স প্যাকেজ
- মাসিক মূল্য: ৬,০০০ টাকা
- গতি: সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস
- ডাটা সীমা: নেই (আনলিমিটেড)
- স্টারলিংক রেসিডেন্স লাইট প্যাকেজ
- মাসিক মূল্য: ৪,২০০ টাকা
- গতি: সর্বোচ্চ ৩০০ এমবিপিএস
- ডাটা সীমা: নেই (আনলিমিটেড)
দুই প্যাকেজেই স্পিড ক্যাপ নেই এবং একবার ডিভাইস সেটআপ করলে মাসিক ফি পরিশোধ করে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে।
এককালীন ডিভাইস সেটআপ খরচ:
প্রতিটি সংযোগের জন্য গ্রাহককে একবার ৪৭,০০০ টাকা খরচ করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে স্টারলিংক ডিশ, রাউটার এবং প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি।
কারা উপকৃত হবেন এই সেবায়?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের যেসব অঞ্চলে এখনো ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট পৌঁছায়নি বা মোবাইল ইন্টারনেটের গতিও অপ্রতুল, সেসব এলাকায় স্টারলিংক বাস্তবিক অর্থেই পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন:
- চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা
- সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চল
- উত্তরবঙ্গের দুর্গম চর
- সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের পাহাড়ি এলাকা
এছাড়া স্টারলিংক ব্যবহার করে নিচের খাতগুলোতে সরাসরি প্রভাব পড়বে:
- ফ্রিল্যান্সার ও রিমোট কর্মী: নিরবচ্ছিন্ন এবং উচ্চগতির সংযোগ তাদের বৈশ্বিক কাজের সক্ষমতা বাড়াবে।
- শিক্ষা খাত: অনলাইন ক্লাস ও ডিজিটাল পাঠদান সহজ হবে।
- স্বাস্থ্য সেবা: টেলিমেডিসিন ও রিমোট ক্লিনিক সেবা বিস্তৃত করা সম্ভব হবে।
- ব্যবসা ও উদ্যোক্তা: ই-কমার্স, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও সাপ্লাই চেইন পরিচালনায় সহায়ক হবে।
মূল্য বেশি হলেও টেকসই সমাধান
ডিভাইস সেটআপ খরচ ও মাসিক ফি তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও, এটি এখনো অনেকের কাছে একটি টেকসই ও প্রিমিয়াম সেবা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ বর্তমানে দেশের অনেক এলাকায় উচ্চগতির অপটিক ইন্টারনেট পৌঁছায়নি, আবার মোবাইল ডেটার উপর নির্ভরশীল হয়ে অনেক গ্রাহক ইন্টারনেট সেবায় সীমাবদ্ধতায় পড়েন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন,
“এই প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামের মানুষের ঘরেও পৌঁছাতে পারে শহরের মতো ইন্টারনেট। এতে গ্রাম-শহরের ডিজিটাল বৈষম্য কমবে।”
স্টারলিংকের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ও বাংলাদেশের গুরুত্ব
বর্তমানে স্টারলিংক বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি অপেক্ষমাণ বাজার, যেখানে ইন্টারনেট প্রবৃদ্ধির হার দ্রুত হলেও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান।
স্টারলিংকের আগমন সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ লক্ষ্য অর্জনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সরকারি নীতিমালায় সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
যদিও এখনো স্পষ্ট নয় স্টারলিংক কিভাবে লাইসেন্স প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বা কোন ব্যান্ডউইথ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে, তবে সরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক নীতিমালা তৈরি করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ:
- স্পেকট্রাম লাইসেন্সিং ফি
- ট্যাক্স ও ভ্যাট সংক্রান্ত প্রক্রিয়া
- তথ্য নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইন
- অবকাঠামোগত সহায়তা (যেমন: বিদ্যুৎ সংযোগ)
সরকার যদি স্টারলিংককে অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয় ইন্টারনেট কাঠামোর অংশ বানাতে পারে, তাহলে এটি হতে পারে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
স্টারলিংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত মাইলফলক। যদিও খরচ কিছুটা বেশি, তবে এর সুবিধা, কভারেজ, এবং গতির দিক থেকে এটি এককথায় বৈপ্লবিক। বিশেষ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য এটি হতে পারে একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সল্যুশন। এখন দেখার বিষয়, সরকারের নীতিগত সমর্থন ও গণসচেতনতার মাধ্যমে কত দ্রুত এটি মূলধারায় প্রবেশ করতে পারে।