টিকটকের উপর ৭২৯৬ কোটি টাকার জরিমানা:আয়ারল্যান্ডের ডেটা প্রোটেকশন কমিশন

জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটকের বিরুদ্ধে ডেটা সুরক্ষা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মোটা অঙ্কের জরিমানা আরোপ করেছে আয়ারল্যান্ডের ডেটা প্রোটেকশন কমিশন (ডিপিসি)। সংস্থাটির তদন্তে দেখা গেছে, টিকটক ইউরোপীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনে প্রেরণের ক্ষেত্রে সাধারণ ডেটা সুরক্ষা নিয়ন্ত্রণ (জিডিপিআর) আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, প্লাটফর্মটিকে ৫৩ কোটি ইউরো জরিমানা করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার সমান। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী ডেটা গোপনীয়তা এবং সামাজিক মাধ্যম প্লাটফর্মগুলোর দায়বদ্ধতার বিষয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ডেটা সুরক্ষা লঙ্ঘনের অভিযোগ
আয়ারল্যান্ডের ডেটা প্রোটেকশন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে যে, টিকটক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইএ) ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনে প্রেরণ করলেও এই তথ্য চীনা সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ডিপিসি জানিয়েছে, টিকটকের ডেটা প্রক্রিয়াকরণ প্রক্রিয়া জিডিপিআরের মৌলিক নীতিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে, ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্লাটফর্মটি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
জিডিপিআর, যা ২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে কার্যকর হয়, ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার জন্য কঠোর নিয়মকানুন আরোপ করে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো সংস্থা যদি ব্যবহারকারীদের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তার বিরুদ্ধে জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। টিকটকের ক্ষেত্রে, ডিপিসি তদন্তে দেখেছে যে, প্লাটফর্মটি ইইএ ব্যবহারকারীদের তথ্য চীনে প্রেরণের সময় পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, যা জিডিপিআরের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
টিকটকের প্রতিক্রিয়া
জরিমানার ঘোষণার পর টিকটক এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে। সংস্থাটির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা এই সিদ্ধান্তকে ‘অন্যায্য’ মনে করে এবং আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিকল্পনা করছে। টিকটকের দাবি, তারা ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং জিডিপিআরের নিয়ম মেনে চলার জন্য নিয়মিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ডিপিসির তদন্তে এই দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
একটি বিবৃতিতে টিকটক আরও জানিয়েছে, তারা ইউরোপে তথ্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধি। সংস্থাটি আশা প্রকাশ করেছে যে, এই উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নত করবে।
ইউরোপে টিকটকের কার্যক্রম
আয়ারল্যান্ডের ডেটা প্রোটেকশন কমিশন ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইইএ) ৩০টি দেশে টিকটকের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এই অঞ্চলের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি আইসল্যান্ড, লিচেনস্টাইন এবং নরওয়ে অন্তর্ভুক্ত। টিকটকের ইউরোপীয় সদর দপ্তর আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত হওয়ায় ডিপিসি এই অঞ্চলে সংস্থাটির কার্যক্রমের উপর নজরদারি করে।
ইউরোপে টিকটকের বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও, প্লাটফর্মটি বারবার ডেটা গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, চীনা মালিকানাধীন সংস্থা বাইটড্যান্সের অধীনে টিকটকের কার্যক্রম নিয়ে ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনা সরকারের সঙ্গে টিকটকের সম্পর্ক এবং ব্যবহারকারীদের তথ্যে সরকারি প্রবেশাধিকারের সম্ভাবনা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্বব্যাপী টিকটকের চ্যালেঞ্জ
ইউরোপে জরিমানার পাশাপাশি টিকটক বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশটির আইনপ্রণেতারা দাবি করেছেন, টিকটকের মাধ্যমে চীনা সরকার আমেরিকান নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে টিকটক যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
জাপানে টিকটক শিগগিরই তাদের ই-কমার্স শাখা ‘টিকটক শপ’ চালু করার পরিকল্পনা করছে। জাপানের প্রভাবশালী সংবাদপত্র নিক্কেইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকটক জাপানে বিক্রেতা নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সংস্থাটি জাপানের ক্রমবর্ধমান অনলাইন শপিং শিল্পে প্রবেশ করতে চায়। তবে, এই বিষয়ে টিকটকের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ডেটা গোপনীয়তার গুরুত্ব
টিকটকের উপর আরোপিত এই জরিমানা ডেটা গোপনীয়তার গুরুত্ব এবং সামাজিক মাধ্যম প্লাটফর্মগুলোর দায়বদ্ধতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলোর প্রতি ব্যবহারকারীদের নির্ভরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য সুরক্ষার বিষয়টি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপিআর আইন এই ধরনের প্লাটফর্মগুলোর উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও, অনেক ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো এই নিয়ম মেনে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, টিকটকের ক্ষেত্রে এই জরিমানা অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর জন্যও একটি সতর্কতা। ব্যবহারকারীদের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে আরও কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া, ডেটা গোপনীয়তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে ব্যবহারকারীদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়ছে, যা প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
টিকটকের জন্য এই জরিমানা একটি বড় ধাক্কা হলেও সংস্থাটি তাদের ব্যবসায়িক কৌশল এবং ডেটা সুরক্ষা নীতি পুনর্বিবেচনার সুযোগ পাচ্ছে। ইউরোপে স্থানীয় ডেটা সেন্টার স্থাপন এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টিকটক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আস্থা ফিরে পেতে পারে। তবে, চীনা মালিকানাধীন সংস্থা হিসেবে টিকটকের উপর ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রভাব অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে, টিকটকের ই-কমার্স উদ্যোগ এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা সংস্থাটির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। তবে, এই সম্প্রসারণ সফল করতে হলে টিকটককে ডেটা গোপনীয়তা এবং নিয়ন্ত্রক সম্মতি নিশ্চিত করার বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে।