প্রযুক্তি

৫০০ টাকায় এখন ১০ এমবিপিএস, গতি বাড়বে ব্রডব্যান্ডেরও

বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রাহকদের জন্য এলো বড় সুখবর। মাসিক মাত্র ৫০০ টাকায় এখন থেকে পাওয়া যাবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সেবা। আজ শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‌‘ইন্টারনেট সেবা: সমস্যা, সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এই ঘোষণা দেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-এর সভাপতি ইমদাদুল হক।

ইভেন্টটি আয়োজন করে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি)। এই ঘোষণার মাধ্যমে দেশের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ব্রডব্যান্ড গ্রাহকের ইন্টারনেট অভিজ্ঞতায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে চলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দ্বিগুণ গতি, একই মূল্য

আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘‘আজ থেকেই গ্রাহকেরা ৫ এমবিপিএস নয়, বরং ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সেবা পাবেন ৫০০ টাকার মাসিক প্যাকেজে।’’ এই পরিবর্তন গ্রাহকদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ইমদাদুল হক আরও জানান, সংগঠনটির লক্ষ্য শিগগিরই একই মূল্যে ন্যূনতম ২০ এমবিপিএস গতি নিশ্চিত করা।

তিনি বলেন, ‘‘আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি খুব শিগগিরই দেশের সব ব্রডব্যান্ড গ্রাহক যেন ৫০০ টাকায় ন্যূনতম ২০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট পায়। এতে দেশের ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, গেমিং ও ডিজিটাল শিক্ষার ক্ষেত্রেও বড় অগ্রগতি হবে।’’

ব্যান্ডউইথ সঞ্চালন খরচ কমানোর দাবি

এদিন গোলটেবিল আলোচনায় দেশের বিভিন্ন ব্রডব্যান্ড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যান্ডউইথ সঞ্চালন খরচ ৫ টাকায় নামিয়ে আনার জোর দাবি জানান। এর পাশাপাশি তাঁরা সরকারের কাছে অ্যাকটিভ শেয়ারিং নীতিমালার সুযোগ তৈরিরও আহ্বান জানান।

বেসরকারি ফাইবার অপারেটরদের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করা হয়। তাদের বক্তব্য, ব্যান্ডউইথের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, অ্যাকটিভ শেয়ারিং এবং ফাইবার অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের ইন্টারনেট সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

সরকারের অবস্থান: ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হবে না

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার মান এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ইন্টারনেট সেবার দাম কমানো এবং গুণগত মান বাড়ানো জরুরি। তবে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে ইন্টারনেট সেবায় কোনো প্রকার শাটডাউন আর যেন না হয়।’’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করছি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যেসব ফাঁকফোকর রয়েছে, সেগুলো বন্ধ করতে। ভবিষ্যতে আর কখনো বাংলাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউন হবে না।’’

সমালোচনায় গ্রাহক সংগঠন

তবে ঘোষিত ন্যূনতম ১০ এমবিপিএস গতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘৫০০ টাকায় ১০ এমবিপিএস ঘোষণা আসলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, সরকার ন্যূনতম গতি নির্ধারণ করবে ২০ এমবিপিএস এবং সর্বোচ্চ গতি ১০০ এমবিপিএস করবে। এতে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি আরও গতিশীল হতো।’’

তিনি আরও জানান, সরকার ইতিমধ্যে সাবমেরিন কেবল ব্যান্ডউইথের মূল্য ১০ শতাংশ কমিয়েছে, পাশাপাশি ফাইবার নেটওয়ার্কের দীর্ঘদিনের জটিলতাও অনেকটাই দূর হয়েছে।

মহিউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যে উঠে আসে একটি বড় অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘‘ভারত থেকে ১ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ মাত্র ৮০ টাকায় আমদানি করা হলেও, দেশে তা লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং গ্রাহকদের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন। সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এই বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।’’

তিনি আরও যুক্ত করেন, ‘‘বর্তমানে আইটিসি (International Terrestrial Cable)-এর মাধ্যমে যে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হয়, তা আসলে পূর্ণাঙ্গ ইন্টারনেট নয়। এটি বিনোদনকেন্দ্রিক ইন্টারনেট, যার মাধ্যমে গ্রাহকের আসল প্রয়োজনীয়তা পূরণ হয় না।’’

প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতামত

প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, ইন্টারনেটের এই গতিবৃদ্ধি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক খবর। তবে ব্যান্ডউইথের প্রকৃত মূল্য এবং বাজারে সঠিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত না হলে, এই গতি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, ই-কমার্স, গিগ-ইকোনমি, ডিজিটাল শিক্ষাসহ অনলাইনভিত্তিক নতুন নতুন উদ্যোগের প্রসার ঘটাতে হলে, ন্যূনতম গতি আরও বাড়ানো এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সমানভাবে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো জরুরি।

আগামী দিনের দৃষ্টিভঙ্গি

বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের ডিজিটাল চাহিদা পূরণের জন্য গতির পাশাপাশি সেবার মান ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আইএসপিএবি এবং সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে গতি বাড়ানোর এ ধরনের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে বাস্তবায়ন ও নজরদারি ছাড়া গ্রাহকের প্রত্যাশা পূরণ হবে না বলেই মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।

গ্রাহকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে, ব্যান্ডউইথ আমদানি থেকে শুরু করে স্থানীয় বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তব রূপ পাবে।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারে এই নতুন দিগন্ত আশার আলো দেখালেও, এখনো সমাধান হয়নি মূল্য, সেবার মান এবং নেটওয়ার্ক স্থিতিশীলতা সংক্রান্ত সমস্যা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই গড়ে উঠতে পারে একটি বাস্তব অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, এই উদ্যোগ দেশের ইন্টারনেট ইকোসিস্টেমের একটি ইতিবাচক ধাপ। তবে গ্রাহকের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার ব্যবধান কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের আরও সক্রিয় হতে হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button