প্রযুক্তি

গুগলের বিজ্ঞাপন আধিপত্য: যুক্তরাষ্ট্রে রায়, যুক্তরাজ্যে ৬৬০ কোটি ডলারের মামলা

বিশ্ব প্রযুক্তির শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান গুগল এক নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি আদালত গুগলের বিরুদ্ধে অনলাইন বিজ্ঞাপন প্রযুক্তির বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভিযোগে রায় দিয়েছেন। রায় অনুযায়ী, গুগল ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের পাবলিশার অ্যাড সার্ভার ও অ্যাড এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাদ দিয়ে নিজেদের বাজার সম্প্রসারণ করেছে। যদিও কোম্পানিটি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে গুগলের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যেও শুরু হয়েছে নতুন একটি বড় ধরনের আইনি লড়াই। প্রায় ৬৬০ কোটি ডলারের (৫ বিলিয়ন পাউন্ড) ক্ষতিপূরণ দাবিতে বিজ্ঞাপনদাতারা মামলা করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে— গুগল প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশ তৈরি করে নিজেদের বিজ্ঞাপনমূল্য ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করছে।

এই দুই দেশজুড়ে আইনগত ঝামেলায় গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসা নতুন করে চাপের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মামলার মূল বিষয়?

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ (DOJ) অভিযোগ তোলে যে, গুগল তাদের মালিকানাধীন Google Ad Manager, DoubleClick, এবং AdMeld প্রযুক্তির সাহায্যে অনলাইন বিজ্ঞাপন বাজারে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে একাধিক প্রতিযোগিতাবিরোধী কাজ করেছে। মূলত দুটি ক্ষেত্রে গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ:

  1. Publisher Ad Server: যেটি ব্যবহার করে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও ওয়েবসাইটগুলো তাদের বিজ্ঞাপন পরিচালনা করে থাকে।
  2. Ad Exchange: যেখানে বিজ্ঞাপনদাতা ও পাবলিশারদের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজ্ঞাপন কেনাবেচা হয়।

বিচারক লিওনি ব্রিনকেমা বলেন, গুগল কৌশলগতভাবে এ দুটি ব্যবস্থাকে এমনভাবে একীভূত করেছে, যাতে প্রতিযোগীদের বাজার থেকে সরিয়ে দিয়ে তারা একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে পারে।

রায়ে বলা হয়, “গুগলের এই কৌশল প্রযুক্তিগত ও নীতিগতভাবে পরিকল্পিতভাবে এমনভাবে তৈরি করা, যা বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধ্বংস করে।”

গুগলের অবস্থান ও আপিলের ঘোষণা

রায়ের পরে গুগল জানায়, তারা এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় এবং উচ্চ আদালতে আপিল করবে। গুগলের বক্তব্য অনুযায়ী, আদালত যে রায় দিয়েছেন তা আংশিক এবং অনেক জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। যেমন:

  • বিচারক স্বীকার করেছেন, গুগলের DoubleClick ও AdMeld অধিগ্রহণ ছিল প্রতিযোগিতাবিরোধী নয়
  • বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য গুগলের টুলসগুলো নিয়ে DOJ যথেষ্ট প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

তবে রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো— পাবলিশার বিজ্ঞাপন টুলস এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এটিই DOJ-এর মূল অভিযোগের ভিত্তি।

যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের সম্ভাব্য প্রভাব

এই মামলার পরিণতি হিসেবে বিচার বিভাগ গুগলকে তাদের Ad Manager বিক্রি করে দিতে বলেছে, যা গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসার একটি বড় অংশ। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে:

  • গুগলের বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
  • প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে সহজে প্রবেশ করতে পারবে।
  • অনলাইন সংবাদমাধ্যম ও পাবলিশারদের ওপর গুগলের নিয়ন্ত্রণ কমবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবসা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলারের বাজারে এককভাবে প্রভাব রাখছে। এই বাজারে যদি গুগলের কর্তৃত্ব সীমিত করা হয়, তবে এটি হতে পারে বিজ্ঞাপন জগতের জন্য একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা।

যুক্তরাজ্যে গুগলের বিরুদ্ধে নতুন মামলা

যুক্তরাষ্ট্রের রায়ের রেশ কাটতে না কাটতেই যুক্তরাজ্যে গুগলের বিরুদ্ধে ৬৬০ কোটি ডলারের মামলা দায়ের হয়েছে। এই মামলার অভিযোগগুলো হলো:

  1. গুগল তাদের বিজ্ঞাপনমূল্য নিজে নির্ধারণ করছে এবং প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অসাধু প্রতিযোগিতা করছে।
  2. গুগল অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে আগেই ইনস্টল করে রাখা সার্চ ও ব্রাউজার (ক্রোম)-এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে।
  3. অ্যাপলের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে গুগল নিজেদের সার্চ ইঞ্জিনকে আইফোনে ডিফল্ট হিসেবে ব্যবহার করাচ্ছে, যা প্রতিযোগিতা নষ্ট করে।

এই মামলাটি ব্রিটিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে করা হয়েছে, যারা গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করছেন।

গুগলের মূল আয়ের উৎস: বিজ্ঞাপন

গুগলের মূল কোম্পানি Alphabet Inc. তাদের মোট আয়ের প্রায় ৮০% বিজ্ঞাপন থেকে পেয়ে থাকে। YouTube, Google Search, Display Ads—সব মিলিয়ে গুগল বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন প্রযুক্তি সরবরাহকারী। এই বিজ্ঞাপন ব্যবস্থায় গুগলের স্বয়ংক্রিয় টুলস ব্যবহার করেই কোটি কোটি ডলার আয় করে তারা।

তবে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি জায়ান্টদের বিরুদ্ধে একচেটিয়া বাজার দখলের অভিযোগ ক্রমশ বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য—সবখানেই এদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা চলমান।

ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রভাব

বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আদালতের রায় অনুযায়ী গুগলকে তাদের বিজ্ঞাপন ব্যবসার একটি বড় অংশ বিক্রি করতে হয়, তবে এটি শুধু গুগলের নয়, পুরো ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ইকোসিস্টেমের জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে।

  • অনলাইন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে।
  • ছোট বিজ্ঞাপন সংস্থা ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য প্রবেশাধিকার সহজ হবে।
  • ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা সংরক্ষণে আরও কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন সম্ভব হবে।

গুগলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্ট যখন বিশ্বজুড়ে আইনি চাপে পড়ে, তখন শুধু ব্যবসায় নয়, সমাজ ও গণমাধ্যমেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভবিষ্যতের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজারে আর একক আধিপত্য থাকবে না—থাকবে প্রতিযোগিতা, স্বচ্ছতা ও বিকল্প।

গুগল আপিল করলেও এই রায় প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাপন বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে। এখন সময় এসেছে আরও উন্মুক্ত, ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক বিজ্ঞাপন ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button