প্রযুক্তি

বিশ্বাসভঙ্গের মামলায় জাকারবার্গের বিচার শুরু: ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রির শঙ্কা

মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট মেটার প্রধান মার্ক জাকারবার্গের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে একটি ঐতিহাসিক বিচারকাজ শুরু হয়েছে ওয়াশিংটনের ফেডারেল আদালতে। এই মামলার রায় মেটাকে তাদের অধিগ্রহণকৃত জনপ্রিয় দুই অ্যাপ—ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ—বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অভিযোগ কী?

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন (FTC) অভিযোগ করেছে, মেটা প্রতিযোগিতা এড়াতে ও বাজারে একচেটিয়া কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ২০১২ সালে ইনস্টাগ্রাম এবং ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করেছে। FTC-এর মতে, ফেসবুক (বর্তমানে মেটা) বুঝতে পেরেছিল যে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ ভবিষ্যতে তাদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা এগুলো কিনে নিয়ে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পথে না গিয়ে সহজ সমাধান বেছে নেয়—প্রতিযোগীদের গ্রাস করে।

FTC-এর আইনজীবী ড্যানিয়েল ম্যাথসনের বক্তব্য অনুযায়ী, “তারা (মেটা) সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিযোগিতা করাটা কঠিন। তাই তারা এগুলো কিনে নেয়।”

মেটার পাল্টা অবস্থান

মার্ক হ্যানসেন, মেটার প্রধান আইনজীবী, মামলায় পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, “কোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য অধিগ্রহণ করা যুক্তরাষ্ট্রে বেআইনি নয়। ফেসবুক সেই কাজটিই করেছে।”

মেটার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আইন মেনেই প্রতিষ্ঠানগুলো অধিগ্রহণ করেছে এবং এর ফলে সেবা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে, ক্ষতি হয়নি।

ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ কেন গুরুত্বপূর্ণ

২০১২ সালে মাত্র ১০০ কোটি ডলারে ইনস্টাগ্রাম কেনার সময় এটি ছোট একটি ছবি শেয়ার করার অ্যাপ ছিল। এখন এর সক্রিয় ব্যবহারকারী সংখ্যা ২০০ কোটির বেশি। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেয় মেটা ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপগুলোর একটি।

এই দুটি অ্যাপই মেটার বিজ্ঞাপনভিত্তিক আয়ের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। তাই আদালতের রায় যদি ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ বিক্রির নির্দেশ দেয়, তাহলে মেটার ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক মডেল গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

জাকারবার্গের রাজনৈতিক তৎপরতা

মার্ক জাকারবার্গের বিরুদ্ধে মামলা প্রথম দায়ের হয়েছিল ২০২০ সালে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হলে মামলাটি থেমে যাবে। সেই আশায় জাকারবার্গ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন, এমনকি হোয়াইট হাউসে একাধিকবার উপস্থিত হন ও ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে অর্থায়নও করেন।

ওয়াশিংটনে ২ কোটি ৩০ লাখ ডলারে বিলাসবহুল ম্যানশন কেনার ঘটনাও সেই সম্পর্কের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ফাঁস হওয়া ইমেইল এবং FTC-এর শক্তিশালী প্রমাণ

FTC আদালতে একাধিক অভ্যন্তরীণ ইমেইল পেশ করেছে, যেখানে দেখা গেছে, ইনস্টাগ্রামের উত্থানকে জাকারবার্গ “আতঙ্ক” হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা না করে কেন কিনে নেওয়া যাবে না?”

আরেকটি ইমেইলে তিনি বলেন, “ইনস্টাগ্রাম চালু থাকুক, তবে নিজস্ব কিছু উন্নয়ন করার দরকার নেই—যাতে হতাশ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে না যায়।”

এইসব প্রমাণ FTC-এর যুক্তিকে আরও জোরালো করে তুলেছে।

সম্ভাব্য ফলাফল: প্রযুক্তি জগতে ভূমিকম্প

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি আদালত মেটার বিরুদ্ধে রায় দেয়, তাহলে এটি হবে আধুনিক প্রযুক্তি ইতিহাসের অন্যতম বড় রায়। তখন মেটাকে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ আলাদা করে বিক্রি করতে হতে পারে।

এতে শুধু মেটা নয়, গুগল, অ্যামাজন, অ্যাপলসহ অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টের ক্ষেত্রেও নজির তৈরি হবে। ভবিষ্যতের অধিগ্রহণ ও একচেটিয়া ক্ষমতা নিয়ে মার্কিন সরকার আরও কঠোর হবে।

মামলা কতদিন চলবে?

প্রত্যাশা করা হচ্ছে, মামলাটি অন্তত আট সপ্তাহ ধরে চলবে। জাকারবার্গের সাবেক সহযোগী শেরিল স্যান্ডবার্গ এবং অন্যান্য বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দেবেন।

এই মামলার রায়ের প্রভাব শুধু মেটার জন্য নয়, পুরো প্রযুক্তি বিশ্বে অনুভূত হবে। জাকারবার্গের নেতৃত্বে গড়া সামাজিক যোগাযোগের সাম্রাজ্যের ভিত্তি নড়ে গেলে, ভবিষ্যতের ডিজিটাল পলিসি ও প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button