বিশ্ববাজারে স্বস্তির হাওয়া, কিন্তু চিন্তা কাটেনি: ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্তে চীনের ওপর অনিশ্চয়তা

ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিত: কী ঘটল বিশ্ববাজারে
গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে অস্থির করে তুলেছিল। পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা, মুদ্রার মান পতন এবং জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তিন মাসের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এশিয়ার শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ইউরোপীয় বাজারেও ইতিবাচক সাড়া মিলছে। বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও চীনের ওপর শুল্ক বহাল থাকায় পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না কেউই।
চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক আরোপ করেছে, তা এখনো বহাল আছে। ফলে চীনের রপ্তানি কার্যক্রমে কোনো উল্লেখযোগ্য গতি ফিরে আসেনি। বিশেষ করে, যেসব দেশ চীনের সরবরাহ চেইনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড—তারা পড়েছে সরাসরি চাপে।
চীনের উৎপাদন কমে গেলে এসব দেশের যোগানখাতেও ধস নামবে, যা পুরো এশিয়ার শিল্প খাতের জন্য অশনিসংকেত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি বাজারের ব্যাপারটি—চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ জ্বালানি আমদানিকারক, ফলে চীনের চাহিদা না বাড়লে তেলের দাম আরও কমতে পারে।
এই দিক থেকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো স্বস্তি পেতে পারে, কারণ বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে এলে আমদানি খরচ হ্রাস পাবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মত: সাময়িক স্বস্তি, স্থায়ী নয়
বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান পেডেন অ্যান্ড রাইগেলের প্রধান অর্থনীতিবিদ জেফরি ক্লিভল্যান্ড বিবিসিকে বলেন—
“আমরা এক চরম অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে সাময়িকভাবে ফিরে এসেছি, কিন্তু বিপদ এখনো কাটেনি। আগামী তিন মাস বিনিয়োগ হ্রাস পেতে পারে।”
জেপি মর্গ্যান-এর বিশ্লেষণেও বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত বিশ্বমন্দার আশঙ্কা থেকে সাময়িক মুক্তি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে। পণ্যের দাম স্বল্পমেয়াদে কমলেও ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
বন্ড বাজারে চাপ ও ট্রাম্পের কৌশল
ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিতের সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে মার্কিন বন্ড বাজারে সুদহার বেড়ে যাওয়া ও বিক্রির চাপ। গতকালই বন্ডের সুদহার উঠে গেছে ৪.৫ শতাংশে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ফেডারেল রিজার্ভ এবং অর্থনৈতিক নীতিপ্রণেতাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, কারণ বন্ড বাজারে অস্থিরতা অর্থনীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
এই অবস্থায় ট্রাম্পের শুল্ক স্থগিত করাকে অনেকেই দেখছেন কৌশলগত পিছু হটা হিসেবে, যাতে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা মসৃণ রাখা যায়। সূত্র অনুযায়ী, ট্রাম্প ইতোমধ্যে ৭৫টির বেশি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছেন।
চীনের শুল্ক স্থগিত না হওয়ায় কী প্রভাব পড়বে?
- রপ্তানিনির্ভর দেশগুলোর সংকট: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীনের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত, ফলে তাদের শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে সমস্যা: চীন থেকে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল সরবরাহ বিঘ্নিত হলে গ্লোবাল প্রোডাকশন স্লোডাউন ঘটবে।
- কার্বন বাজারে প্রভাব: চীনের উৎপাদন কমে গেলে কার্বন নিঃসরণ কমবে, কিন্তু এতে পরিবেশগতভাবে ভালো হলেও শিল্প বাজারে চাপ বাড়বে।
বিনিয়োগ কমতে পারে, বাজারে অনিশ্চয়তা থাকছে
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই তিন মাসের শুল্ক বিরতি বাজারকে কিছুটা সময় দেবে, কিন্তু নতুন বিনিয়োগ গ্রহণে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়, এবং যেকোনো সময় মার্কিন প্রশাসন ফের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে।
মূল প্রশ্ন—এই তিন মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে কি না? যদি না পারে, তবে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ ধাক্কা আসতে পারে অর্থনীতিতে।
ট্রাম্পের মন্তব্য: “আরও দারুণ দিন আসছে”
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আলোচনার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লিখেছেন—
“দারুণ একটা দিন গেল। আরও দারুণ দিন আসছে।”
এই মন্তব্যে অনেকে রাজনৈতিক কৌশল দেখলেও, বাস্তবতা হলো—বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।