কেউ যেন ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা হচ্ছে: ফয়েজ আহমদ

ইন্টারনেট এখন কেবলমাত্র তথ্য আদান–প্রদানের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্যাংকিং, ফ্রিল্যান্সিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রতিটি খাতে অপরিহার্য একটি নাগরিক অধিকার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে—দেশে আর কখনো যেন ইন্টারনেট বন্ধ করা না যায়, সেই লক্ষ্যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনের প্রথম দিনের সমাপনী ব্রিফিংয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন—ইন্টারনেট যেন আর কখনো বন্ধ করা না হয়। আমরা দেখেছি, গত জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধের ফলে ফ্রিল্যান্সার, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাসহ সব পর্যায়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এমনকি, ব্যাংকিং খাতে এর প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিকভাবে, যার ফলে দেশের ক্রেডিট রেটিং কমে যায়।”
চারটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, সরকার ইতোমধ্যে ইন্টারনেট সংযোগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রতিরোধে চারটি আইনি ও নীতিগত উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রথম পদক্ষেপ:
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “এই সপ্তাহে অথবা আগামী সপ্তাহে যেই সাইবার সেইফটি অর্ডিন্যান্স পাস হবে, সেখানে আমরা প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছি। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ যা বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।”
দ্বিতীয় পদক্ষেপ:
ইন্টারনেট বন্ধের অনুমোদন সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে প্রশাসনিক পর্যায় থেকে ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে অপব্যবহারের সুযোগ কমে যাবে।
তৃতীয় পদক্ষেপ:
উপগ্রহ ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী স্টারলিংককে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে যে নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) গাইডলাইন তৈরি হয়েছে, সেখানে ইন্টারনেট বন্ধের কোনো বিধান রাখা হয়নি। এই গাইডলাইন অনুযায়ী, সরকার কোনোভাবেই স্টারলিংক বা অনুরূপ সেবা প্রদানকারীদের সংযোগ বন্ধ করতে পারবে না।
চতুর্থ পদক্ষেপ:
২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনে যে ধারা ছিল, যার মাধ্যমে সরকার ইন্টারনেট বা গেটওয়ে বন্ধ করতে পারত, সেটি সংশোধনের কাজ চলছে। ফয়েজ আহমদ বলেন, “আমরা আইনটিকে এমনভাবে সংশোধন করছি, যাতে আগামীতে কোনো সরকার আর ইচ্ছামতো ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করতে না পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই চারটি পদক্ষেপ কেবল বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক নয়, বরং ভবিষ্যত সরকারগুলোর জন্যও একধরনের সাংবিধানিক এবং আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।”
বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চায় সরকার
বিশেষ সহকারী তৈয়্যব জানান, আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অন্যতম বড় উদ্বেগ ছিল ইন্টারনেট ব্যবহারের অনিশ্চয়তা। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার ঘটনায় একদিকে যেমন ব্যবসার ক্ষতি হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আস্থা ও বিনিয়োগের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
“আমরা বিনিয়োগকারীদের সামনে স্পষ্ট করে বলেছি, বাংলাদেশ একটি সংযুক্ত এবং স্বাধীন ডিজিটাল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা যে নীতিমালাগুলো নিচ্ছি, সেগুলোর লক্ষ্যই হচ্ছে একটি মুক্ত এবং নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করা,” বলেন ফয়েজ আহমদ।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন: কোথায় দাঁড়িয়ে?
অনুষ্ঠানে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন (ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট) নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, মে মাসের মধ্যে আইনটির খসড়া সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
তিনি বলেন, “গত দুই সপ্তাহ ধরে এটি অনলাইনে ছিল এবং বাছাইকৃত কিছু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স (অ্যামচেম) ও কিছু আর্থিক আইন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মতামতও পাওয়া গেছে।”
ফয়েজ আহমদ জানান, এপ্রিলের শেষ নাগাদ আবারও খসড়াটি আপডেট করে অনলাইনে প্রকাশ করা হবে এবং মে মাসের মধ্যে সকল নাগরিক, প্রতিষ্ঠান এবং অংশীজনদের মতামতের জন্য তা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “আমরা তরুণ উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তি-নির্ভর স্টার্টআপদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, তাদের গোপনীয়তা ও তথ্য সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে এই আইন একটি কার্যকর হাতিয়ার হবে।”
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ: ডিজিটাল নিরাপত্তার নতুন অধ্যায়
ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সরকার কর্তৃক ইন্টারনেট বন্ধের সম্ভাবনা স্থায়ীভাবে বন্ধ করার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও বিনিয়োগ খাতে একটি বড় অগ্রগতি। এটি প্রযুক্তি নির্ভর ভবিষ্যতের জন্য দেশের প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে ডিজিটাল স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে এবং তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের ভিত গড়ে তুলবে না, বরং এটি নাগরিক অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাষ্ট্রের জবাবদিহিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেও নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে।