বাংলাদেশে মোবাইল ফোন রেজিস্ট্রেশনকে আরও আধুনিক, নিরাপদ এবং জনবান্ধব করতে সরকার বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। বিশেষ করে প্রবাসীরা দেশে ছুটি কাটাতে এলে, তাদের ব্যবহৃত স্মার্টফোন রেজিস্ট্রেশন নিয়ে চলমান জটিলতা এবং বিভ্রান্তি দূর করতেই নতুন নীতিমালা তৈরি হয়েছে।
সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসীরা দেশে এসে ৬০ দিনের মধ্যে মোবাইল ফোন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ব্যবহার করতে পারবেন।
তবে ৬০ দিনের বেশি অবস্থান করলে তাঁদের মোবাইল আইএমইআই বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, বিটিআরসি ও প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি সম্পর্কিত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
প্রবাসীদের জন্য নতুন সুবিধা: বিএমইটি কার্ড থাকলে আনতে পারবেন তিনটি ফোন
সভায় প্রবাসীদের জন্য আরেকটি বড় সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে—
যেসব প্রবাসীর কাছে বিএমইটি (বুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) কার্ড আছে, তারা দেশে আসার সময় মোট তিনটি মোবাইল ফোন আনতে পারবেন।
এর মধ্যে থাকবে—
- নিজের ব্যবহারের ফোন
- অতিরিক্ত দুটি নতুন ফোন
এই তিনটির জন্য কোনো অতিরিক্ত কর বা শুল্ক দিতে হবে না।
তবে চতুর্থ ফোন আনলে স্বাভাবিক শুল্ক দিতে হবে।
যাদের বিএমইটি কার্ড নেই, তারা কী পাবেন?
যারা বিএমইটি কার্ডবিহীন, তারা—
• নিজের ব্যবহারের ফোন
• অতিরিক্ত একটি নতুন ফোন
এই দুইটি ট্যাক্স ছাড়াই আনতে পারবেন। এর বেশি আনতে চাইলে শুল্ক প্রযোজ্য হবে।
কেন ফোন কেনার কাগজপত্র সাথে রাখতে হবে
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিদেশি বিমানবন্দরগুলো—বিশেষ করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এক শ্রেণির চোরাচালানকারী প্রবাসীদের চাপ দিয়ে তাদের লাগেজে ব্যয়বহুল মোবাইল, স্বর্ণ ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য বহন করানোর চেষ্টা করে।
এই ধরনের অপচেষ্টা ঠেকাতে প্রবাসীদের—
মোবাইল কেনার বৈধ কাগজপত্র সাথে রাখতেই হবে।
এটি কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাজকে সহজ করবে এবং প্রবাসীদেরও ভুলভাবে অভিযুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
বৈধ মোবাইল আমদানিতে বড় পরিবর্তন: শুল্ক কমছে উল্লেখযোগ্য হারে
সভায় অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত ছিল মোবাইল আমদানির শুল্ক কমানো।
এখন বৈধ পথে মোবাইল ফোন আমদানির ওপর মোট শুল্ক প্রায় ৬১ শতাংশ।
এই শুল্ক অত্যন্ত বেশি হওয়ায়—
• সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যের অভাবে স্মার্টফোন কিনতে পারতেন না
• বাজারে অবৈধ ও চোরাচালানের ফোনের প্রবাহ বাড়ছিল
• স্থানীয় ডিভাইস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে সংকটে পড়ছিল
সেজন্যই সরকার বৈধ আমদানিতে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শুল্ক কমলে কী হবে?
• বৈধ ফোনের দাম কমে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে
• গ্রাহকরা আর অবৈধ বা নন–রেজিস্টার্ড সেট কিনে বিপদে পড়বেন না
• বাজারে অবৈধ ফোনের প্রবাহ কমবে
• সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে
• ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি ও এনবিআর এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছে এবং সমন্বয় করে শুল্কহার নির্ধারণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
দেশে বিদেশি পুরোনো ফোন ঢোকানো সম্পূর্ণ বন্ধ হবে
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়—
অনেক দিন ধরে বিদেশে ফেলে দেওয়া পুরোনো ফোন, নষ্ট ফোন বা কেসিং বদলে নতুন রূপ দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকানোর প্রবণতা বেড়েছে। এগুলো আসলে ইলেকট্রনিক বর্জ্য (E-waste), যা পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক।
এই চক্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, চীন, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ থেকে পুরোনো ফোন এনে বাংলাদেশে ঢোকায়।
ফলে—
• স্থানীয় বাজারে নকল ও নিম্নমানের ফোন বেড়ে যায়
• গ্রাহকরা প্রতারিত হন
• রিমোটলি ট্র্যাকিং বা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থাকে
• অনুমোদিত কোম্পানির বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়
এ কারণে বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে বিশেষ পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হয়েছে।
কাস্টমস শিগগিরই অভিযান শুরু করবে
বিমানবন্দরের স্ক্যানিং ইউনিট, সাইবার ইউনিট এবং কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স যৌথভাবে অভিযান চালাবে।
অনুমোদনহীন পুরোনো ফোন বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য ঢুকাতে চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার নামে অন্য কেউ সিম ব্যবহার করছে কিনা, এখনই জেনে নিন
বিজ্ঞপ্তিতে জনগণকে বিশেষ সতর্ক করা হয়েছে—
বর্তমানে সাইবার অপরাধ, অনলাইন স্ক্যামিং, ফেসবুক প্রতারণা, জুয়া অ্যাপ, ফেক আইডি, মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতি—এসব অপরাধে অপরাধীরা অন্যের নামে রেজিস্টার্ড সিম ব্যবহার করছে।
সেজন্য বলা হয়েছে—
• সবসময় নিজের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করুন
• আপনার নামে কতটি সিম নিবন্ধিত আছে, নিয়মিত যাচাই করুন
• অজানা নম্বরে ওটিপি, পিন বা কোড শেয়ার করবেন না
• মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন
সরকার নতুন সিম রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ করতে ই-কেওয়াইসি (eKYC) এবং শক্তিশালী আইএমইআই ডেটা সুরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করছে।
টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ (সংশোধনী) ২০২৫: ডেটা সুরক্ষায় নতুন ব্যবস্থা
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে—
• সিম রেজিস্ট্রেশন ডেটা
• আইএমইআই রেজিস্ট্রেশন ডেটা
• গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য
• বায়োমেট্রিক যাচাই
এসব তথ্য সুরক্ষায় বিশেষ ধারা যোগ করা হয়েছে।
যদি কেউ এসব তথ্য ফাঁস করে বা অপব্যবহার করে, তাহলে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়বে।
মন্ত্রণালয় বলছে—
উদ্বেগ বা ভয়ের কোনো কারণ নেই।
গুজব ছড়ানো বা আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা না করতে সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে।
কেন মোবাইল রেজিস্ট্রেশন জরুরি
মোবাইল রেজিস্ট্রেশন (আইএমইআই এনইআইআর সিস্টেম) চালুর মাধ্যমে—
• চুরি হওয়া ফোন বন্ধ করা যায়
• অপরাধীদের ট্র্যাক করা সহজ হয়
• স্ক্যামিং, সাইবার অপরাধ কমে
• অবৈধ বা নকল ফোন নেটওয়ার্কে উঠতে না পারে
• জাতীয় নিরাপত্তা শক্তিশালী হয়
সরকার মনে করছে, প্রবাসীদের জন্য সুবিধা বাড়ালে তারা হয়রানি কম ভোগ করবেন এবং পুরো সিস্টেম আরও কার্যকর হবে।
প্রবাসীদের জন্য সার্বিক নির্দেশনা (সহজভাবে)
- দেশে এলে ৬০ দিন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই ফোন ব্যবহার করতে পারবেন
- ৬০ দিনের বেশি অবস্থান করলে ফোন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে
- বিএমইটি কার্ড থাকলে তিনটি ফোন আনতে পারবেন
- বিএমইটি কার্ড না থাকলে আনতে পারবেন দুটি
- কেনার কাগজপত্র অবশ্যই রাখতে হবে
- চতুর্থ ফোন আনলে শুল্ক দিতে হবে
- পুরোনো ফোন আমদানির চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা
- নিজের নামে নিবন্ধিত সিম ছাড়া ব্যবহার করবেন না
- সন্দেহজনক সিম বা নম্বর দেখলে চেক করুন
- অবৈধ ফোন শিগগিরই নেটওয়ার্কে চলবে না
বাংলাদেশে মোবাইল রেজিস্ট্রেশন ও আমদানি নীতিতে এই বড় পরিবর্তন শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিকেই নয়, পুরো দেশের মোবাইল বাজার, আইনশৃঙ্খলা, প্রযুক্তি খাত ও ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। সরকার চাইছে—একদিকে প্রবাসীরা ঝামেলা ছাড়াই ফোন আনতে পারুক, অন্যদিকে অবৈধ ফোন, নকল সেট, ইলেকট্রনিক বর্জ্য এবং সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকুক।
নতুন নীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন শুরু হলে মোবাইল বাজার আরও স্থিতিশীল ও গ্রাহকবান্ধব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
MAH – 14112 I Signalbd.com



