প্রযুক্তি

ইমোশন ট্র্যাকিং এআই নিষিদ্ধ করল ইউরোপীয় ইউনিয়ন: প্রযুক্তি জগতে যুগান্তকারী আইন

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, যা ইমোশন ট্র্যাকিং প্রযুক্তির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০২৫ সালের ২ অগাস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে বা জনসমক্ষে মানুষের আবেগ পর্যবেক্ষণের জন্য ওয়েবক্যাম ও ভয়েস রিকগনিশন সিস্টেম ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হবে। পাশাপাশি, এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ আদায় করার প্রবণতাও কঠোরভাবে দমন করা হবে।

নতুন আইনের মূল উদ্দেশ্য

ইউরোপীয় কমিশনের মতে, এই আইন প্রণয়নের মূল লক্ষ্য হলো এআইভিত্তিক বৈষম্য, হয়রানি ও কারসাজি থেকে মানুষকে রক্ষা করা। প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গোপনীয়তা রক্ষা এবং ডিজিটাল অধিকার নিশ্চিত করাই ইইউ-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই আইনের মাধ্যমে এআই ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে চায় ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

একজন কমিশন কর্মকর্তা ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট-কে বলেন, “এই আইনের মাধ্যমে ইউরোপীয় বাজারে এআই ব্যবস্থা সরবরাহ ও পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষাই নয়, বরং এআই সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর জন্যও আইনি নিশ্চয়তা প্রদান করবে।”

নিষিদ্ধ এআই চর্চাগুলোর তালিকা

এই নতুন আইনের অধীনে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  1. কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের আবেগ পর্যবেক্ষণ:
    • ওয়েবক্যাম ও ভয়েস রিকগনিশনের মাধ্যমে কর্মীদের অনুভূতি পর্যবেক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
    • কোম্পানিগুলো কর্মীদের আবেগগত তথ্য সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করতে পারবে না।
  2. সামাজিক স্কোরিং নিষিদ্ধ:
    • কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে এমন এআই-ভিত্তিক সামাজিক স্কোরিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
    • বিশেষত, সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা বংশগত পরিচয়, জাতিগত তথ্য বা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে কোনো নাগরিককে স্কোর করতে পারবে না।
  3. বায়োমেট্রিক তথ্যের অপব্যবহার রোধ:
    • শুধুমাত্র বায়োমেট্রিক ডেটার ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে না, যদি না এর পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকে।
    • পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তির মাধ্যমে জনসমক্ষে নজরদারি চালাতে পারবে না, বিশেষ করে মোবাইল সিসিটিভির মাধ্যমে।
  4. এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণা ও জালিয়াতি:
    • অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে এআই ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের অর্থ পরিশোধে বাধ্য করা বা প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
    • কোনো এআই-চালিত অ্যাপ বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতি করা হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও জরিমানা

ইইউ দেশগুলোকে এই আইন বাস্তবায়নের জন্য আগামী ২ অগাস্ট ২০২৫ পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দেশকে বাজার নজরদারি কর্তৃপক্ষ মনোনীত করতে হবে, যারা এআই ব্যবহারের ওপর নজরদারি করবে।

আইন লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে কোম্পানিগুলোকে তাদের বার্ষিক বৈশ্বিক আয়ের ১.৫% থেকে ৭% পর্যন্ত জরিমানা দিতে হতে পারে। বিশেষ করে, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইন মেনে চলার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কেন এই আইন গুরুত্বপূর্ণ?

বিশ্বজুড়ে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার মধ্যে ইমোশন ট্র্যাকিং, ফেসিয়াল রিকগনিশন ও স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো প্রযুক্তি রয়েছে। তবে এসব প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইইউ-এর এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষক ড. জনাথন স্মিথ বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই আইন বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করবে এবং মানুষের গোপনীয়তাকে সুরক্ষিত করবে।”

বিশ্বে এর প্রভাব

  • যুক্তরাষ্ট্র ও চীন: বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনেও এআই ব্যবহারের নীতিমালা কঠোর করার পরিকল্পনা চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য দেশগুলোকেও তাদের এআই নীতিগুলো পুনর্মূল্যায়নে উৎসাহিত করতে পারে।
  • বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানি: গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, এবং মেটার মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন তাদের এআই পরিষেবাগুলো ইইউ-এর নতুন আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।

উপসংহার

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন এআই আইন প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। এই আইন গোপনীয়তা রক্ষা, সামাজিক বৈষম্য হ্রাস এবং এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সহায়ক হবে। যদিও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বজুড়ে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, তবে এর নিরাপদ এবং নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ইইউ-এর নতুন আইন ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটি মানদণ্ড হিসেবে কাজ করবে, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button