মহাকাশের রহস্য যেন শেষ হয় না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার আমাদের এই বিশাল মহাবিশ্বের অজানা দিকগুলো উন্মোচন করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (James Webb Space Telescope) আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত একটি অস্বাভাবিক নক্ষত্রব্যবস্থার ছবি তুলেছে। এই ছবি শুধু চমক নয়, বিজ্ঞানীদের জন্য এক নতুন গবেষণার ক্ষেত্রও তৈরি করেছে।
নতুন এই চিত্রে দেখা গেছে, চার স্তরের বিরল সর্পিল কাঠামো। বিজ্ঞানীদের মতে, এই নক্ষত্রব্যবস্থাটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৮ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এর নাম রাখা হয়েছে অ্যাপেপ নক্ষত্র কাঠামো। নামকরণটি মিসরের বিশৃঙ্খলার দেবতা অ্যাপেপ থেকে নেওয়া হয়েছে।
আগে এই কাঠামোটিতে কেবল একটি আবরণ শনাক্ত করা গিয়েছিল। তবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের নতুন ইনফ্রারেড ছবিতে দেখা গেছে, পুরো কাঠামোটিতে মোট চারটি পৃথক আবরণ রয়েছে। এই আবরণগুলো গত ৭০০ বছরে গঠিত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মূল উপাদান হলো কার্বন ধূলিকণা, যা দুটি বিরল নক্ষত্র থেকে নির্গত হয়েছে।
উলফ-রেয়েট নক্ষত্র এবং বিরল ঘটনা
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের চিত্রগুলোতে দেখা দুটি নক্ষত্র হলো উলফ-রেয়েট নক্ষত্র। এই ধরনের নক্ষত্র বিরল এবং তারা তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে অবস্থান করছে। আমাদের মিল্কিওয়েতে এই ধরনের প্রায় এক হাজার নক্ষত্র রয়েছে।
অ্যাপেপ নক্ষত্র কাঠামোর দুটি নক্ষত্র প্রতি ১৯০ বছরে একবার একে অপরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করে। এরপর তারা ২৫ বছরের জন্য কাছাকাছি অবস্থান নেয়। এই সময়ে তাদের মধ্যে উৎপন্ন শক্তিশালী নক্ষত্রিক বায়ু সংঘর্ষ করে এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন সমৃদ্ধ ধূলিকণা নির্গত হয়। এই ধূলিকণা পরে চার স্তরের আবরণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়িনুও হান ও রায়ান হোয়াইট বলেন, “এই দুই নক্ষত্রের সংঘর্ষ এবং ধূলিকণার নির্গমন আমাদের জন্য মহাবিশ্বের আবহাওয়া এবং নক্ষত্র গঠনের প্রক্রিয়া বোঝার গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করছে।”
তৃতীয় নক্ষত্র এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের চিত্রে দেখা গেছে, একটি তৃতীয় নক্ষত্রও রয়েছে। এটি আমাদের সূর্যের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ গুণ বড়। গবেষকরা বলেন, তৃতীয় নক্ষত্রটির আবরণের মধ্যে একটি গহ্বর বা ফানেলের মতো গঠন দেখা গেছে।
এই নক্ষত্রের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত চমকপ্রদ। এটি ভবিষ্যতে সুপারনোভা বিস্ফোরণে ভেঙে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে। এটি আমাদের মহাবিশ্বের নক্ষত্রজীবনের পরিপূর্ণ চক্র এবং সুপারনোভা প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করবে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের অবদান
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এখন পর্যন্ত মহাকাশ বিজ্ঞানে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। এর ইনফ্রারেড চিত্রগুলি আমাদের পূর্বে অদৃশ্য নক্ষত্র এবং গ্যাস-ধুলো আবরণকে স্পষ্টভাবে দেখাতে সক্ষম। বিশেষ করে অস্বাভাবিক নক্ষত্র কাঠামো এবং ধূলিকণা ছড়িয়ে থাকা গ্যালাক্সির বিশ্লেষণে এটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নাসার তথ্যমতে, টেলিস্কোপটি ২০২১ সালে উৎক্ষেপণ হওয়ার পর থেকে বহু গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ এবং মহাকাশীয় ধূলিকণার বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই তথ্যের মাধ্যমে নক্ষত্রের জীবনচক্র, সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং গ্যালাক্সির গঠন বোঝা সহজ হয়েছে।
মহাকাশের রহস্য ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা
অ্যাপেপ নক্ষত্র কাঠামোর মতো ঘটনা আমাদের শিখায় যে মহাবিশ্ব কেবল চমকপ্রদ নয়, এটি বিস্ময়ের ভাণ্ডার। এই ধরনের অস্বাভাবিক নক্ষত্রব্যবস্থা আমাদের নতুন পদার্থবিজ্ঞান, নক্ষত্রবিজ্ঞান এবং মহাকাশ গবেষণার দিকে নিয়ে যায়।
গবেষকরা বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত এমন কিছু দেখছি যা আমাদের আগে কল্পনাতেও ছিল না। প্রতিটি নতুন আবিষ্কার আমাদের মহাবিশ্বের ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ বোঝার একটি নতুন সূচনা। অ্যাপেপ নক্ষত্র কাঠামো আমাদের গ্যালাক্সির ক্রিয়াশীল প্রক্রিয়া, নক্ষত্রের মৃত্যু এবং ধূলিকণার বিস্তার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছে।”
মহাকাশের অজানাকে বোঝার জন্য প্রযুক্তি এবং পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের সেই দরজা খুলে দিয়েছে, যেখানে প্রতিটি ছবি নতুন রহস্য উন্মোচন করে। অ্যাপেপ নক্ষত্র কাঠামো আমাদের শেখাচ্ছে যে মহাবিশ্ব কেবল বিস্ময় নয়, এটি চিরন্তন পরিবর্তনের গল্প।
গবেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে আরও উন্নত টেলিস্কোপ এবং মহাকাশ পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এমন আরও অস্বাভাবিক নক্ষত্রব্যবস্থা এবং গ্যাস-ধূলি আবরণ সম্পর্কে জানতে পারব। এভাবেই মহাবিশ্বের রহস্য ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে।
MAH – 13968 I Signalbd.com



