প্রযুক্তি

মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনে কেন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর তোড়জোড়

Advertisement

ডেটার জগতে এক নতুন দিগন্ত

আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এখন ডেটার ওপর নির্ভরশীল—স্মার্টফোন, ব্যাংক, হাসপাতাল, এমনকি বিনোদনও। কিন্তু এই তথ্যসমুদ্রের পেছনে রয়েছে এক অদৃশ্য শক্তি—ডেটা সেন্টার। আর এখন এই ডেটা সেন্টারগুলোই পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে উড়তে চলেছে

শুনতে অবাক লাগলেও, এটি আর কল্পনা নয়। বিশ্বের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের দিকেই ঝুঁকছে। কারণ, পৃথিবীতে জমি, শক্তি এবং পরিবেশের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে, মহাকাশই হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির নতুন ঘাঁটি।

এআই যুগে ডেটা সেন্টারের চাহিদা বেড়েই চলেছে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) এখন বিশ্বের প্রযুক্তি বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এই বুদ্ধিমত্তা চালাতে যে বিপুল ডেটা প্রক্রিয়াকরণ লাগে, তার সবটাই হয় ডেটা সেন্টারে।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ লাখের বেশি ডেটা সেন্টার কাজ করছে, আর এদের শক্তি খরচ একেকটি ছোট দেশের সমান।
গোল্ডম্যান স্যাকস-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ চাহিদা ১৬৫% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

এই বিপুল চাহিদা শুধু বিদ্যুৎ নয়, পরিবেশের ওপরও চাপ ফেলছে। ডেটা সেন্টার থেকে প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়েও সমাধান মিলছে না পুরোপুরি

অনেক ডেটা সেন্টার এখন সোলার বা উইন্ড ফার্ম ব্যবহার করছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব স্থাপনা তৈরির জন্যও বিপুল জমি লাগে।
একই সঙ্গে, সূর্যালোকের অপ্রতুলতা, আবহাওয়ার পরিবর্তন, কিংবা রাতের সময় শক্তি উৎপাদনে সীমাবদ্ধতা থাকে।

এই চ্যালেঞ্জই বিজ্ঞানীদের নতুন ভাবনায় নিয়ে যাচ্ছে—
“যদি ডেটা সেন্টার পৃথিবীতে না রেখে মহাকাশে পাঠানো যায়?”

মহাকাশে ডেটা সেন্টার: ইউরোপের ASCEND প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ভাবনা

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ASCEND (Advanced Space Cloud for European Net zero Data center) নামে একটি প্রকল্প চলছে, যার লক্ষ্য—
মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার তৈরি করে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং টেকসই সমাধান খোঁজা।

এই প্রকল্প পরিচালনা করছে থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস (Thales Alenia Space)। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, যদি মহাকাশ থেকে সরাসরি অবিচ্ছিন্ন সৌরশক্তি ব্যবহার করা যায়, তবে তা হবে তথ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ উপায়

থ্যালিস অ্যালেনিয়ার প্রকৌশলী হাভিয়ের রোশে বলেন,

“এই ধারণা বাস্তবায়ন করতে গেলে আরও কিছু প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দরকার, বিশেষ করে শক্তি ব্যবস্থাপনা ও তাপ নিয়ন্ত্রণে।”

মহাকাশে সৌরশক্তির সম্ভাবনা

মহাকাশে সূর্যালোক পৃথিবীর তুলনায় ৩০% বেশি শক্তিশালী। সেখানে মেঘ নেই, দিন-রাতের কোনো সীমা নেই, আবহাওয়ার পরিবর্তনও নেই।
অর্থাৎ, মহাকাশ থেকে পাওয়া যাবে ২৪ ঘণ্টা অবিচ্ছিন্ন সৌরশক্তি

এই শক্তি দিয়ে ডেটা সেন্টার চালানো গেলে বিদ্যুৎ খরচ ব্যাপকভাবে কমবে এবং পরিবেশের ওপর চাপও হ্রাস পাবে।

বাস্তবে কারা এগিয়ে? ইউরোপ: ASCEND প্রকল্প

২০২৪ সালে থ্যালিস অ্যালেনিয়া তাদের গবেষণার প্রথম ধাপ শেষ করেছে। পরবর্তী ধাপে ছোট আকারের অরবিটাল ডেটা মডিউল পরীক্ষার পরিকল্পনা রয়েছে।

চীন: ১২ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

চীন ইতোমধ্যে মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের প্রথম ধাপে ১২টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে।
দেশটির লক্ষ্য, ২৮০০ স্যাটেলাইটের একটি সম্পূর্ণ কনস্টেলেশন (constellation) তৈরি করা—যা হবে বিশ্বের প্রথম “স্পেস ডেটা ক্লাউড”।

মাদারি স্পেস

আবুধাবিভিত্তিক স্টার্টআপ মাদারি স্পেস ২০২৬ সালে তাদের প্রথম মহাকাশ ডেটা স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে।
প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও শারিফ আল রোমাইসি বলেন,

“পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইটের সংগৃহীত ডেটা যদি মহাকাশেই প্রক্রিয়াকরণ করা যায়, তাহলে সময় ও শক্তি দুই-ই বাঁচবে।”

যুক্তরাষ্ট্র: লোনস্টার ও স্টারক্লাউড

লোনস্টার ডেটা হোল্ডিংস ইতিমধ্যে চাঁদের মাটিতে একটি ছোট ডেটা সেন্টারের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে।
আর স্টারক্লাউড আগামী নভেম্বরে এমন একটি স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে, যা থাকবে NVIDIA H-100 GPU-এর শক্তিতে চালিত—মহাকাশে এটি হবে সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটিং ইউনিট।

স্টারক্লাউডের সিইও ফিলিপ জনস্টন বলেন,

“আগামী ১০ বছরে বিশ্বের বেশিরভাগ নতুন ডেটা সেন্টার মহাকাশেই তৈরি হবে। কারণ পৃথিবীর এনার্জি সীমিত, কিন্তু মহাকাশ অসীম।”

খরচ ও চ্যালেঞ্জ

তবে এই পুরো প্রকল্প এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে। মহাকাশে ডেটা সেন্টার পাঠাতে খরচ বিপুল।
রকেট উৎক্ষেপণের সময় প্রতি কিলোগ্রামে প্রায় ৫-১০ হাজার ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে।

লোনস্টার তাদের প্রকল্পের জন্য ১২০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে Sidus Space-এর সঙ্গে। প্রথম স্যাটেলাইট হবে ১৫-পেটাবাইট ক্ষমতার, যা চাঁদের কক্ষপথ থেকে পরিচালিত হবে।
প্রতিটি লঞ্চে খরচ হতে পারে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার

তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি স্থলভিত্তিক ডেটা সেন্টারের চেয়ে সাশ্রয়ী হতে পারে, কারণ মহাকাশে বিদ্যুৎ, জমি ও শীতলীকরণ ব্যয় থাকবে না।

ঝুঁকি: স্পেস ডেব্রিস ও বিকিরণ

মহাকাশে রয়েছে কোটি কোটি কণিকা ও ধ্বংসাবশেষ (space debris)। এগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটলে স্যাটেলাইট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তাছাড়া, মহাকাশে উচ্চমাত্রার বিকিরণ (radiation) ডেটা চিপগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করতে পারে।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুয়েন্টিন পার্কার বলেন,

“মহাকাশে ডেটা সেন্টার নির্মাণ এখনো অর্থনৈতিকভাবে অতি ব্যয়বহুল। পৃথিবীতেই অনেক টেকসই বিকল্প আছে।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, মহাকাশে মানবসৃষ্ট আবর্জনার পরিমাণ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে দৈনন্দিন যোগাযোগব্যবস্থার জন্য হুমকি হতে পারে।

নিরাপত্তা ও সুবিধা

অন্যদিকে, সমর্থকদের দাবি—
মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার সাইবার আক্রমণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিদ্যুৎ বিপর্যয় থেকে নিরাপদ থাকবে।

কারণ পৃথিবীর কোনো যুদ্ধ, সুনামি বা ভূমিকম্প মহাকাশের সেই ডেটাকে ছুঁতে পারবে না।
এছাড়া, মহাকাশ থেকে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট কাভারেজরিয়েল-টাইম ডেটা অ্যাক্সেস সম্ভব হবে।

ভবিষ্যতের দিগন্ত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দশকে আমরা দেখতে পারি—
পৃথিবীর বদলে মহাকাশেই গড়ে উঠছে ডেটা সেন্টারের নতুন শহর।

তবে প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত—এই তিন চ্যালেঞ্জ জয় করতে পারলেই এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে।

মাদারি স্পেসের প্রধান শারিফ আল রোমাইসি বলেন,

“আমাদের পৃথিবীর বাইরে তাকাতে হবে। না হলে আমরা প্রযুক্তিগত স্থবিরতায় পড়ব। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে টিকে থাকতে মহাকাশই হবে ডেটার নতুন গন্তব্য।”

মহাকাশে ডেটা সেন্টার হয়তো আজকের দিনে ব্যয়বহুল, কিন্তু আগামী দিনের জন্য এটি হতে পারে সবচেয়ে টেকসই ও নিরাপদ সমাধান
যেভাবে একসময় ইন্টারনেট ছিল কল্পনা, আজ তা বাস্তবতা—তেমনি হয়তো আগামী দশকে “স্পেস ডেটা সেন্টার” হবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রযুক্তির মেরুদণ্ড।

MAH – 13433 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button