
থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে তৈরি এক অভিনব যন্ত্র এখন বাতাস থেকে তৈরি করছে বিশুদ্ধ পানি। জার্মানির দুই তরুণীর এই আবিষ্কার পানি সংকটে ভোগা বিশ্বের কোটি মানুষের জন্য নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে।
হাওয়া থেকেই মিলবে বিশুদ্ধ পানি
বিশ্বজুড়ে বাড়ছে পানি সংকট। বহু অঞ্চলে খাওয়ার উপযোগী পানির অভাব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জার্মানির দুই তরুণী উদ্ভাবক এক অভিনব যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা হাওয়া থেকেই বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারে।
এই যন্ত্রের নাম ‘ওয়াটার ফ্রম এয়ার’। সম্পূর্ণ থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে তৈরি এই যন্ত্র প্রতিদিন প্রায় ছয় লিটার পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন করতে সক্ষম।
এই যুগান্তকারী যন্ত্রটি তৈরি করেছেন জার্মানির এফএইচ মুনস্টার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস–এর দুই স্নাতক, লুইসা গ্রাউপে ও জুলিকা শোয়ার্জ।
যন্ত্রটির কাজের পদ্ধতি
‘ওয়াটার ফ্রম এয়ার’ যন্ত্রটি বাতাসের আর্দ্রতা সংগ্রহ করে সেটিকে ঘনীভবনের মাধ্যমে পানিতে রূপান্তর করে। এতে ব্যবহৃত হয়েছে মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক (MOF) নামের এক বিশেষ উপাদান, যা বাতাসের দূষিত পদার্থ ফিল্টার করে আর্দ্রতা ধরে রাখে।
এই আর্দ্রতা পরে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ঘনীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হয়। ফলে বাহ্যিক বিদ্যুৎ বা রাসায়নিক উপাদানের প্রয়োজন হয় না।
যন্ত্রটির নিচের দিকে একটি ছোট কল বা নল বসানো আছে, যেখান থেকে সরাসরি পানি সংগ্রহ করা যায়। এটি পুরোপুরি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে বলে পরিবেশবান্ধব হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির চমক
যন্ত্রটির প্রায় সব অংশই থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিতে তৈরি। এর গঠন দেখতে অনেকটা কফি মেকার বা ‘ফ্রেঞ্চ প্রেস’-এর মতো। একাধিক অংশ একটির ওপর আরেকটি বসানো যায়, ফলে যন্ত্রটি সহজে বহনযোগ্য।
প্রতিটি চক্র সম্পন্ন হতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে, যাতে প্রায় ৫০০ মিলিলিটার পানি পাওয়া যায়। তবে যন্ত্রটি সারাদিন চললে এটি প্রায় ছয় লিটার পর্যন্ত পানি তৈরি করতে পারে—যা একটি ছোট পরিবারের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট।
থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের সুবিধা হলো, যন্ত্রটির ডিজাইন ফাইল সহজেই ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ ও শেয়ার করা যায়। ফলে বিশ্বের যেকোনো স্থানে এই ডিজাইন ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে যন্ত্রটি তৈরি করা সম্ভব হবে।
বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও পরিবেশবান্ধব সমাধান
বিশ্বজুড়ে যখন পানি সংকট বাড়ছে, তখন এই যন্ত্রটি একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি বা জটিল রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন নেই। শুধু বাতাসে থাকা আর্দ্রতাই এর প্রধান উৎস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুষ্ক বা খরাপ্রবণ এলাকায়, বিশেষ করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই যন্ত্রটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এটি ভবিষ্যতের অন্যতম উদ্ভাবন হতে পারে।
পানি সংকট: বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পানি সংকটে ভুগছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ রয়েছেন চরম পানি সংকটে।
বর্তমান পানি পরিশোধন বা সরবরাহ পদ্ধতিগুলো সাধারণত ব্যয়বহুল এবং বড় আকারের, যা সাধারণ পরিবারের পক্ষে ব্যবহার করা কঠিন। কিন্তু “ওয়াটার ফ্রম এয়ার” যন্ত্রটি ছোট, সাশ্রয়ী ও ব্যবহারযোগ্য বলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এটি এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
গবেষণার অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
লুইসা ও জুলিকা জানিয়েছেন, যন্ত্রটি এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন পরিবেশে এর কার্যকারিতা যাচাই করা হচ্ছে। বর্তমানে তারা এর পেটেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন।
এছাড়া যন্ত্রটির উপাদান আরও সাশ্রয়ী ও টেকসই করার জন্য কাজ চলছে। প্রকৌশলীরা আশা করছেন, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে গেলে এটি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, “ওয়াটার ফ্রম এয়ার” প্রযুক্তি ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার জন্য গেমচেঞ্জার হতে পারে। কারণ, পানি সংকট এখন শুধু আফ্রিকার নয়—দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বহু অঞ্চলেও এটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, “এই প্রযুক্তি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিপ্লব ঘটাবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাতেও এটি কার্যকর হতে পারে।”
ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন আনতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ওয়াটার ফ্রম এয়ার” প্রযুক্তি শুধু পরিবারিক নয়, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দূরবর্তী গবেষণা কেন্দ্র বা সামরিক ঘাঁটির মতো স্থানে জরুরি পানি সরবরাহে সহায়ক হতে পারে।
এছাড়া মানবিক সংকটের সময়, যেমন বন্যা বা ভূমিকম্পের পর বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিলে, এই যন্ত্র সহজ সমাধান দিতে পারবে। যেহেতু এতে বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই, তাই দূরবর্তী বা বিদ্যুৎবিহীন এলাকাতেও এটি কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে।
যন্ত্রটি এখনও গবেষণার পর্যায়ে থাকলেও এর ধারণা ও নকশা ভবিষ্যতের জন্য এক বিশাল আশার প্রতীক। একদিন হয়তো এমন সময় আসবে, যখন প্রত্যেক ঘরে ছোট একটি “ওয়াটার ফ্রম এয়ার” যন্ত্র থাকবে, যা বাতাস থেকেই বিশুদ্ধ পানি তৈরি করবে।
এই আবিষ্কার প্রমাণ করেছে — প্রযুক্তি শুধু আরাম নয়, টিকে থাকারও সমাধান হতে পারে।
এম আর এম – ১৮৩৫,Signalbd.com