
বিশ্বের প্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মহাকাশে গিগাওয়াট স্কেলের বিশাল ডেটা সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান জেফ বেজোস। এটি শুধুমাত্র প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য নয়, বরং পৃথিবীর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার কার্যক্ষমতা ও স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড কম্পিউটিং এবং ডেটা স্টোরেজের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর উপর ভিত্তি করে থাকা ডেটা সেন্টারের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ এবং পানি প্রয়োজন। বিশেষ করে, ডেটা সেন্টারের সার্ভারগুলোকে ঠান্ডা রাখতে হাজার হাজার লিটার পানি এবং প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যয় হয়। এই প্রক্রিয়া পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জেফ বেজোস জানিয়েছেন, মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার তৈরির মূল কারণ হলো নিরবচ্ছিন্ন সৌরশক্তি। মহাকাশে সূর্য সর্বদা উপলব্ধ থাকায়, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। সেখানকার আবহাওয়া বা মেঘবৃষ্টি কখনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
বেজোস বলেন, “আমরা যদি এই বিশাল AI প্রশিক্ষণ ক্লাস্টারগুলো মহাকাশে স্থাপন করি, তাহলে পৃথিবীর উপর ভিত্তি করে থাকা ডেটা সেন্টারের তুলনায় কম খরচে আরও কার্যকর পরিষেবা দিতে পারব।”
মহাকাশে ডেটা সেন্টারের সম্ভাব্য সুবিধা
মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের ফলে প্রযুক্তি এবং মানবজীবনের জন্য যে সুবিধাগুলো আশা করা হচ্ছে, তা বেশ উল্লেখযোগ্য:
- নিরবচ্ছিন্ন সৌরশক্তি
মহাকাশে সূর্য সর্বদা আলোকিত থাকে। ফলে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব। - কম খরচে অপারেশন
দীর্ঘ সময় ধরে সৌরশক্তি ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ খরচ কমে। এছাড়া, মহাকাশে সাপ্লাই চেইন এবং পানি সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় কমে। - উচ্চ পারফরম্যান্স সার্ভার
সার্ভার ঠান্ডা রাখতে বেশি জটিলতার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর ডেটা সেন্টারের তুলনায় অপারেশন আরও দ্রুত হবে। - পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের কারণে পৃথিবীর পরিবেশে বিদ্যুৎ ও পানি সংরক্ষণ সম্ভব। - বৃহৎ ডেটা হ্যান্ডলিং ক্ষমতা
এআই, ক্লাউড কম্পিউটিং এবং বড় ডেটা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে।
জেফ বেজোসের পরিকল্পনা এবং বক্তব্য
গতকাল ইতালীয় টেক উইকে ফেরারির চেয়ারম্যান জন এলকানের সঙ্গে আলাপকালে জেফ বেজোস জানিয়েছেন, আগামী দুই দশকে মহাকাশে গিগাওয়াট স্কেলের ডেটা সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
বেজোস বলেন, “এটি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, এটি একটি বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। পৃথিবীর ডেটা সেন্টারের উপর নির্ভরতা কমানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করা আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন, মহাকাশে ডেটা সেন্টার নির্মাণের পরবর্তী ধাপ হবে শিল্প উৎপাদন, বিশেষ করে যে ধরণের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচুর বিদ্যুৎ এবং উন্নত প্রযুক্তি লাগে।
মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের চ্যালেঞ্জ
মহাকাশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের সুবিধার পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
- উচ্চ খরচ
রকেট উৎক্ষেপণ এবং মহাকাশে যন্ত্রাংশ পাঠানোর ব্যয় প্রচুর। - রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা
যেকোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ঠিক করা, আপগ্রেড করা বা মেরামত করা মহাকাশে অত্যন্ত জটিল। - উৎক্ষেপণ ব্যর্থতার ঝুঁকি
রকেট উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হলে পুরো প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। - টেকনোলজির সীমাবদ্ধতা
মহাকাশে দীর্ঘ সময় স্থিতিশীল সার্ভার চালানো এবং যোগাযোগ স্থাপন করা প্রযুক্তিগতভাবে চ্যালেঞ্জিং।
তবুও, জেফ বেজোস দৃঢ়ভাবে মনে করেন যে আগামী দুই দশকে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং খরচের হ্রাস মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারকে সম্ভবপর করবে।
অন্যান্য প্রযুক্তি সংস্থার আগ্রহ
বিশাল প্রযুক্তি সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই মহাকাশে ডেটা সেন্টার নির্মাণের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। কিছু সংস্থা ছোটমাত্রার উপগ্রহভিত্তিক ডেটা সেন্টার এবং ক্লাউড সার্ভার পরীক্ষা করছে।
বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বড় ডেটা অ্যানালিটিকস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এবং মেটাভার্সের ব্যবহার বাড়ায় এই উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার প্রযুক্তি বাস্তবায়িত হলে এটি পৃথিবীতে প্রযুক্তি খাতে এক বিপ্লব ঘটাবে।
পৃথিবীতে প্রযুক্তি ও জীবনমানের উন্নয়ন
বেজোসের মতে, মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রযুক্তির পাশাপাশি মানুষের জীবনমানও উন্নত হবে। উদাহরণস্বরূপ, আবহাওয়া পূর্বাভাস, যোগাযোগ স্যাটেলাইট, স্বয়ংক্রিয় যানবাহন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই মহাকাশভিত্তিক অবকাঠামোর ব্যবহার হচ্ছে।
মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের পরবর্তী ধাপ হবে আরও বড় উৎপাদন এবং শিল্প উদ্যোগ। এটি প্রযুক্তি খাতকে এক নতুন মাত্রা দেবে।
মহাকাশে গিগাওয়াট ডেটা সেন্টার নির্মাণ পরিকল্পনা শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রতীক নয়, এটি পৃথিবীর জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার পথ। নিরবচ্ছিন্ন সৌরশক্তি, পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম এবং কম খরচের অপারেশন এই উদ্যোগকে এক অনন্য দিগন্তে নিয়ে যাবে।
যদিও উচ্চ খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টার ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও ব্যবসা খাতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিপ্রেমীরা এবং বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলো মহাকাশভিত্তিক ডেটা সেন্টারের দিকে নজর দিচ্ছে। এটি কেবল ভবিষ্যতের ডেটা সংরক্ষণ বা কম্পিউটিং নয়, বরং পৃথিবীর প্রযুক্তি, পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের এক বৃহৎ প্রক্রিয়ার অংশ।
কীভাবে মহাকাশের প্রযুক্তি আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে পরিবর্তন করবে, তা আগামী দুই দশকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
MAH – 13156 I Signalbd.com