
বাংলাদেশি কিশোরদের হাত ধরে আবারো বিশ্বমঞ্চে বাজল বিজয়ের সুর। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইনোভেশান কম্পিটিশন এন্ড এক্সিবিশান (WISE) ২০২৫-এ স্বর্ণপদক জয় করেছে বাংলাদেশের তরুণ প্রতিযোগী দল ‘কিডজানা – আকাশ পাঠাবো’।
২১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর সেগি ইউনিভার্সিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই prestigious প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক দল অংশ নেয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগী দলের সঙ্গে।
কিন্তু সব প্রতিযোগীদের ছাড়িয়ে বাংলাদেশি কিশোরদের তৈরি রোবট ‘জেফিরন’ বিচারকদের মন জয় করে নেয়। আইটি ও রোবোটিক্স (IR) ক্যাটাগরিতে এই রোবটটি জিতে নেয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতি— স্বর্ণপদক।
জেফিরন: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশি কিশোরদের তৈরি রোভার ‘জেফিরন’ মূলত একটি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট রোবট। রোবটটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের সহায়তায় কাজ করতে পারে।
‘জেফিরন’-এর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো:
- অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা
- ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গ্যাস ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ
- স্বাস্থ্য পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা
- পরিবেশগত ঝুঁকি শনাক্তকরণ
- ২০টিরও বেশি স্বয়ংক্রিয় ফাংশন
এই সবগুলো কার্যক্রম একসঙ্গে করার ক্ষমতা থাকায় এটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিচারকরা মন্তব্য করেছেন, এমন উদ্ভাবনী রোবট ভবিষ্যতে মানবজীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজয়ী দলের সদস্য ও পরামর্শকরা
বাংলাদেশের হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া টিমটির সদস্যরা হলেন –
- সাফি বিন সুলতান
- সাফওয়ান সাদাদ
- সাবিক বিন সুলতান
তাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন কিডজানা ক্রিয়েটিভ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মোসাদ্দেক হোসেন এবং সার্বিক সহায়তায় ছিলেন কিডজানার সিএমও সাদেকুল ইসলাম।
তরুণদের এই অর্জন নিয়ে দলীয় উপদেষ্টা মোসাদ্দেক হোসেন বলেন,
“আমাদের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। তারা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বে দেশের মান উজ্জ্বল করছে। এই অর্জন কেবল কিডজানা নয়, পুরো জাতির জন্যই এক বিশাল গর্ব।”
কিডজানা ক্রিয়েটিভ সেন্টার: নতুন প্রজন্মের উদ্ভাবন ঘর
এই সাফল্যের পেছনে মূল ভুমিকা রাখছে কিডজানা ক্রিয়েটিভ সেন্টার। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), গণিত, ও বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করছে।
তাদের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে:
- আফটার স্কুল প্রোগ্রাম
- ক্রিয়েটিভ সেমিনার
- রোবটিক্স ওয়ার্কশপ
- উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতা
শুধু বাংলাদেশেই নয়, কিডজানা এখন সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যৌথভাবে কাজ করছে। আধুনিক শিক্ষা উপকরণ ও প্রজন্মভিত্তিক শিক্ষণ কৌশল নিয়ে তারা নতুন ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট।
বাংলাদেশি কিশোরদের বৈশ্বিক সাফল্যের ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একের পর এক সাফল্য অর্জন করছে।
- ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত রোবটিক্স অলিম্পিয়াড-এ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা রৌপ্য পদক জিতেছিল।
- ২০২৪ সালে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত টেকনোভেশন চ্যালেঞ্জ-এ কিশোরীরা উদ্ভাবনী অ্যাপ তৈরি করে বিশ্বব্যাপী সেরা পাঁচের মধ্যে স্থান পেয়েছিল।
এরপর ২০২৫ সালে এই স্বর্ণপদক জয় প্রমাণ করছে, প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কতটা অগ্রসর হচ্ছে।
কেন এমন সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশ এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, মেশিন লার্নিং এবং অটোমেশনের মতো প্রযুক্তি বিশ্ব অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের হাতে এমন উদ্ভাবন কেবল দেশের সম্মান বাড়ায় না, বরং ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্যও বড় ভিত্তি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরণের অর্জনগুলো তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি উদ্দীপনা যোগাবে।
সরকার ও নীতিনির্ধারকদের করণীয়
এই ধরণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে কাজে লাগিয়ে সরকার চাইলে শিশু-কিশোরদের উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রসারিত করতে পারে।
- প্রতিটি জেলায় রোবোটিক্স ল্যাব স্থাপন
- স্কুল পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন
- আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক সহায়তা
- উদ্ভাবনী প্রকল্পকে স্টার্টআপে রূপান্তরের সুযোগ তৈরি
এসব উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে।
বাংলাদেশি কিশোরদের উদ্ভাবিত রোবট ‘জেফিরন’ শুধু একটি স্বর্ণপদকই জয় করেনি, বরং বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিভা ও সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই সাফল্য প্রমাণ করছে, সঠিক দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পেলে বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
এখন প্রয়োজন সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বিত সহযোগিতা, যাতে এ ধরণের উদ্ভাবন কেবল পুরস্কার জয়েই সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে পারে।
বাংলাদেশি কিশোরদের এই সাফল্য আজকের তরুণদের অনুপ্রাণিত করবে আগামী দিনের বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে।
MAH – 13015 I Signalbd.com