
মানবজাতি আবারও চাঁদের পথে পা রাখতে চলেছে। ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো-১৭-এর পর দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে চাঁদে কোনও মানুষের যাত্রা হয়নি। এবার নাসা (NASA) আর্টেমিস-২ মিশনের মাধ্যমে এই শূন্য পূরণ করতে যাচ্ছে। আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই মিশনে চারজন নভোচারী চাঁদকে ঘিরে ১০ দিনের মহাকাশ অভিযানে অংশ নেবেন।
নাসার এই যাত্রা শুধু একটি “চাঁদে অবতরণ” অভিযান নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের চন্দ্র অভিযানের জন্য রকেট, মহাকাশযান এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি পরীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিজ্ঞানীরা এটিকে একটি প্রাকৃতিক পরীক্ষা ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন, যাতে পরবর্তী মিশনে মানুষের চাঁদে অবতরণ সুরক্ষিত ও কার্যকর হয়।
আর্টেমিস-২ মিশনের নভোচারী দল
নাসার চার সদস্যের নভোচারী দল-এ রয়েছেন:
- রিড ওয়াইজম্যান
- ভিক্টর গ্লোভার
- ক্রিস্টিনা কচ
তাদের সঙ্গে রয়েছেন কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির জেরেমি হ্যানসেন, যারা এই মিশনের আন্তর্জাতিক অংশ।
নাসার প্রধান ফ্লাইট ডিরেক্টর জেফ রাডিগান সাংবাদিকদের জানান, “নভোচারীরা এই মিশনে চাঁদের কক্ষপথ ছাড়িয়ে অন্তত ৫ হাজার নটিক্যাল মাইল (৯,২০০ কিলোমিটার) অতিক্রম করবেন। এটি এখন পর্যন্ত যেকোনো মিশনের চেয়ে অনেক বেশি দূরত্ব।”
নভোচারীরা SLS (Space Launch System) রকেটের উপর থাকা ওরিয়ন ক্যাপসুলে অবস্থান করবেন। পুরো যাত্রাকালেই এই ক্যাপসুল তাদের বাসস্থান হিসেবে কাজ করবে।
আর্টেমিস-২ যাত্রার ধাপসমূহ
নাসা যাত্রার পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে পরিকল্পনা করেছে। যাত্রার প্রধান ধাপগুলো নিম্নরূপ:
- প্রাথমিক উৎক্ষেপণ
যাত্রা শুরু হওয়ার প্রথম দুই মিনিটে দুটি সলিড রকেট বুস্টার বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবে। এর পর আট মিনিটে দ্বিতীয় স্টেজ শুরু হবে। এই ধাপে ইন্টারিম ক্রায়োজেনিক প্রপালশন সিস্টেম (ICPS) ওরিয়ন ক্যাপসুল থেকে আলাদা হবে। - কক্ষপথে প্রবেশ ও সিস্টেম পরীক্ষা
ওরিয়ন ক্যাপসুল সৌর প্যানেল মেলে ব্যাটারি চার্জ করবে। এরপর ৯০ মিনিট পর ICPS ইঞ্জিন চালু করে মহাকাশযানকে পৃথিবীর একটি উঁচু কক্ষপথে তুলবে। পরবর্তী ২৫ ঘণ্টা ধরে চলবে পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম পরীক্ষা। - প্রক্সিমিটি অপারেশনস ডেমোনস্ট্রেশন
নভোচারীরা হাত দিয়ে ওরিয়নের থ্রাস্টার নিয়ন্ত্রণ করে ICPS-এর দিকে এগিয়ে যাবেন এবং পুনরায় দূরে সরে আসবেন। এটি মূলত ভবিষ্যতের চন্দ্র ল্যান্ডিং-এর জন্য ডকিং পদ্ধতির মহড়া। - চাঁদের দিকে যাত্রা
প্রায় ২৩ ঘণ্টা পর ওরিয়ন সার্ভিস মডিউল চালু করে (Translunar Injection) চাঁদের দিকে যাত্রা শুরু করবে। এই চার দিনের যাত্রায় নভোচারীরা পৃথিবী থেকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মাইলেরও বেশি দূরে চলে যাবেন এবং নিয়মিত সিস্টেম পরীক্ষা চালাবেন।
স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান পরীক্ষা
নভোচারীরা মানবদেহে মহাকাশ পরিবেশের প্রভাব বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার অংশ নেবেন। তাদের রক্ত থেকে অর্গানয়েড নামে ক্ষুদ্র অঙ্গের মতো টিস্যু তৈরি করা হবে। যাত্রার আগে এবং পরে এই টিস্যুগুলোর তুলনা করে দেখা হবে:
- মাইক্রোগ্র্যাভিটি-এর প্রভাব
- তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব
- মানবদেহে কোষগত পরিবর্তন
নাসার বিজ্ঞান প্রধান ড. নিকি ফক্স বলেন, “নভোচারীদের শরীর পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, তাই এই ছোট টিস্যুগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাব। এটি আমাদের ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানকে অনেক বেশি নিরাপদ করবে।”
পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন
মিশনের শেষ ধাপটি হবে পৃথিবীতে নিরাপদভাবে অবতরণ। ওরিয়ন সার্ভিস মডিউল চাঁদ থেকে ফিরে আসার পর ক্রু মডিউল থেকে আলাদা হবে। ক্যাপসুলটি প্যারাশুটের সাহায্যে ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে অবতরণ করবে।
এই মিশনের সাফল্যের উপর নির্ভর করবে নাসার পরবর্তী চন্দ্র অভিযান আর্টেমিস-৩ কত দ্রুত শুরু হবে। তবে নাসা জানিয়েছে, এটি সম্ভব হতে পারে ২০২৭ সালের মাঝামাঝি। এই অভিযানে ব্যবহার করা হবে স্পেসএক্সের স্টারশিপ, যা এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।
আর্টেমিস-২ মিশনের গুরুত্ব
এই মিশন শুধুমাত্র মানবজাতির চাঁদের দিকে যাত্রা নয়, বরং এটি বহু প্রযুক্তিগত পরীক্ষা ও ভবিষ্যৎ অভিযানের প্রস্তুতি। এর মধ্যে রয়েছে:
- চন্দ্রপৃষ্ঠে মানুষের জন্য নিরাপদ ল্যান্ডিং প্রযুক্তি
- মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদি মানব বসবাসের প্রয়োজনীয়তা
- নবীন মহাকাশযান ও রকেট প্রযুক্তি
- মানবদেহে মহাকাশ পরিবেশের প্রভাব
নাসা আশা করছে, আর্টেমিস-২ মিশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে মহাকাশ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
চাঁদ ও মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত
মানবজাতির জন্য চাঁদ সবসময়ই রহস্যময়। ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং-এর নেতৃত্বে অ্যাপোলো-১১ অভিযান প্রথম মানুষকে চাঁদে পৌঁছে দেয়। ১৯৭২ সালের অ্যাপোলো-১৭ ছিল শেষ অভিযাণ। এরপর দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে চাঁদে কোনও মানুষের পদার্পণ হয়নি।
এবার আর্টেমিস-২ মিশনের মাধ্যমে মানুষ কেবল চাঁদ ঘুরে দেখবে না, বরং ভবিষ্যতের স্থায়ী চন্দ্র বসতি নির্মাণের জন্য প্রযুক্তিগত ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রস্তুতি নেবে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
মিশনটিতে কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি-র অংশগ্রহণ একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা এই মিশনের বিভিন্ন দিকের উপর কাজ করছেন।
এটি প্রমাণ করছে যে মহাকাশ গবেষণা একক দেশের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
নাসার লক্ষ্য:
- ২০২৭ সালের মধ্যেই আর্টেমিস-৩ মিশন
- চাঁদে মানুষের স্থায়ী বসতি
- স্পেসএক্স স্টারশিপের মাধ্যমে বৃহৎ চন্দ্র অভিযান
- মহাকাশে দীর্ঘমেয়াদি মানব বসবাসের প্রযুক্তি বিকাশ
এই মিশন সফল হলে, মানবজাতির জন্য চাঁদ আর কেবল একটি দূরের লক্ষ্য থাকবে না; এটি হবে মহাকাশে বাণিজ্য, গবেষণা এবং মানব বসতির কেন্দ্র।
আর্টেমিস-২ মিশন মানবজাতির মহাকাশ ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করবে। নভোচারীরা চাঁদের কক্ষপথ অতিক্রম করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে। পুরো পৃথিবী এই অভিযানকে চোখ বুলিয়ে দেখবে। সফল মিশনের মাধ্যমে পরবর্তী চন্দ্র অভিযান আর্টেমিস-৩-এর পথ সুগম হবে।
নাসার এই মিশন মানবজাতিকে চাঁদের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে, আর ভবিষ্যতে মহাকাশে মানুষের স্থায়ী বসতি স্থাপনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।
MAH – 12993 I Signalbd.com