প্রযুক্তি

চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে: কারণ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ আমাদের রাতের আকাশকে আলোকিত করে। তবে আপনি কি জানেন যে চাঁদ ধীরে ধীরে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? বিজ্ঞানীরা বলেছেন, প্রতি বছর চাঁদ গড়ে প্রায় ৩.৮ সেন্টিমিটার বা ১.৫ ইঞ্চি হারে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদিও এই পরিবর্তন অত্যন্ত ধীর, তবুও আধুনিক মহাকাশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়েছে।

চাঁদ কতটা দূরে এবং কিভাবে পরিমাপ করা হয়?

চাঁদ ও পৃথিবীর গড় দূরত্ব প্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার কিলোমিটার (২ লাখ ৩৯ হাজার মাইল)। তবে চাঁদের কক্ষপথ একদম বৃত্তাকার নয়, ফলে এক মাসের মধ্যে দূরত্বে প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পার্থক্য দেখা যায়। যখন চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসে, তখন তা ‘সুপারমুন’ হিসেবে দেখা যায়। এই সময় চাঁদ আকাশে বড় এবং উজ্জ্বল প্রদর্শিত হয়।

চাঁদের দূরত্ব পরিমাপ করার জন্য নাসা এবং অ্যাপোলো অভিযানে নভোচারীরা বিশেষভাবে প্রস্তুত করা আয়নার ওপর লেজার রশ্মি পাঠায়। লেজার আলো চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ফিরে আসতে কত সময় নেয়, তা পরিমাপ করে বিজ্ঞানীরা জানেন চাঁদের দূরত্ব কত দ্রুত বাড়ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গত কয়েক দশক ধরে চাঁদের ক্রমবর্ধমান দূরত্ব সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য পাওয়া গেছে।

চাঁদ দূরে সরে যাওয়ার কারণ

চাঁদ দূরে সরে যাওয়ার মূল কারণ হলো জোয়ার-ভাটা। চাঁদের মহাকর্ষ পৃথিবীর এক পাশকে অন্য পাশের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ বেশি আকর্ষণ করে। ফলে পৃথিবীর দুই পাশে দুটি জোয়ার স্ফীতি তৈরি হয়—একটি চাঁদের দিকে মুখ করে, অপরটি বিপরীত দিকে।

পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় নিজের অক্ষের চারপাশে ঘোরে। এই ঘূর্ণনের কারণে জোয়ার স্ফীতি চাঁদের সরাসরি আকর্ষণের তুলনায় সামান্য এগিয়ে থাকে। এই সামান্য অগ্রগতি পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে, যা চাঁদকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে চাঁদের গতি বাড়ে এবং কক্ষপথ দীর্ঘ হয়।

চাঁদের দূরত্ব বাড়ার এই প্রক্রিয়ার কারণে পৃথিবীর ঘূর্ণনও ধীর হয়ে যাচ্ছে। প্রতি শতাব্দীতে দিন দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৩ মিলিসেকেন্ড বেড়ে যায়। তবে এই পরিবর্তন মানবদর্শনে খুবই ছোট, তাই দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ ঘণ্টার কাছাকাছিই থাকে।

চাঁদ ও পৃথিবীর অতীত সম্পর্ক

চাঁদ প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়। বৈজ্ঞানিক মত অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে একটি বৃহৎ গ্রহাকৃতি বস্তু পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রচুর উপাদান মহাকাশে ছিটকে যায়। সেই উপাদানগুলো মিলিত হয়ে চাঁদ গঠন করে।

প্রাথমিক সময়ে চাঁদ ছিল পৃথিবীর অনেক কাছে। তখন চাঁদের প্রভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন অনেক দ্রুত হতো। প্রাচীন জীবাশ্ম এবং প্রাকৃতিক স্তরের তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ৭ কোটি বছর আগে এক দিনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ২৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। সেই সময় আকাশে চাঁদ অনেক বড় দেখাত।

বর্তমান প্রভাব ও মানবজাতির জন্য তাৎপর্য

চাঁদ শুধু পৃথিবীর রাতকে আলোকিত করেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি পৃথিবীর জোয়ার নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাঁদের দূরে সরে যাওয়া এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের ধীরগতি, সমুদ্রপৃষ্ঠের জোয়ার এবং মহাসাগরের স্রোতের উপর প্রভাব ফেলে।

নিউইয়র্ক বা লস অ্যাঞ্জেলেসের মতো শহরে, জোয়ার সময় সমুদ্রের ঢেউ ৫ ফুট পর্যন্ত ওঠানামা করতে পারে। চাঁদের ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়ার কারণে এই জোয়ার-ভাটার তীব্রতা কয়েক কোটি বছরের মধ্যে কমে যেতে পারে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

চাঁদের ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও, এটি মানব জীবনের জন্য তাৎক্ষণিক কোনো বিপদ সৃষ্টি করবে না। প্রতিবছর গড়ে ১.৫ ইঞ্চি দূরে সরে যাওয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং জোয়ার-ভাটার প্রভাবে মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনে খুবই সামান্য প্রভাব ফেলে।

বেশ কয়েক বিলিয়ন বছর পর, সূর্য রেড জায়ান্টে পরিণত হলে পৃথিবী ও চাঁদ দুটোই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে এর আগ পর্যন্ত পৃথিবী ও চাঁদ মিলিতভাবে সৌরজগতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।

চাঁদ নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক তথ্য

  1. কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য: চাঁদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, যার ফলে প্রতি মাসে পৃথিবীর দূরত্বে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
  2. চাঁদের প্রভাব: চাঁদ পৃথিবীর ঘূর্ণন, জোয়ার-ভাটার তীব্রতা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের ধরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
  3. ভবিষ্যতের গবেষণা: নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ সংস্থা চাঁদের দূরত্ব, তার পৃষ্ঠের কাঠামো এবং ভূতাত্ত্বিক গঠন নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করছে।
  4. মহাকাশ প্রযুক্তি: লেজার র‍্যাঞ্জিং প্রযুক্তি চাঁদের দূরত্ব নির্ভুলভাবে পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।

চাঁদ আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

চাঁদ কেবল রাতকে আলোকিত করে না, এটি পৃথিবীর জোয়ার, আবহাওয়া এবং ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর প্রভাবে মহাসাগর ও নদীর স্রোত নিয়মিত থাকে, যা সমুদ্রজীবী প্রাণী এবং মানবজাতির জন্য অপরিহার্য।

চাঁদের ধীরে ধীরে দূরে সরে যাওয়া প্রক্রিয়া আমাদের সৌরজগতের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ইতিহাস বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা পৃথিবী ও চাঁদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সম্পর্ক বুঝতে পারি।

চাঁদ প্রতি বছর ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মূল কারণ জোয়ার-ভাটা এবং চাঁদের মহাকর্ষ। যদিও এই পরিবর্তন মানবজীবনের জন্য তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে না, তবে এটি পৃথিবী ও চাঁদের ভবিষ্যতের সম্পর্ক বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদের গবেষণা চলতে থাকায় আমরা সৌরজগতের এই একক প্রাকৃতিক উপগ্রহের রহস্য আরও গভীরভাবে জানতে সক্ষম হব।

MAH – 12886  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button