
গাজ্জায় চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকট নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা এখন চরম হতাশাজনক। সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের সিনিয়র মিডিয়া ম্যানেজার শাইমা আল-ওবাইদি এক হৃদয়বিদারক মন্তব্য করেছেন, যা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন, গাজ্জার ছোট ছোট শিশু তাকে বলেছে—
“আমরা মরতে চাই, যেন জান্নাতে গিয়ে অন্তত খাবার পেতে পারি।”
এই বক্তব্যে গাজ্জার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।
ত্রাণ বন্ধ হওয়ার পর ভয়াবহ পরিস্থিতি
শাইমা আল-ওবাইদি বলেন, তিনি রমজান মাসে (মার্চ মাসের শুরুতে) গাজ্জায় অবস্থান করছিলেন। তখন এক সময় হঠাৎ করে ত্রাণ প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তার ভাষায়—
“আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, রমজানের শুরুতে বাজারে হঠাৎ লেটুস পাতা পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ খুশিতে ইফতারের সালাদ নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু পাল্টে যায়। প্রোটিনের জোগান শেষ হয়ে যায়, মাংস পাওয়া বন্ধ হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে বাজারে কোনো তাজা সবজি থাকেনি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফলমূলও সম্পূর্ণ শেষ। এক মাসের মধ্যেই ময়দা পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যে অল্প খাবার ছিল, তার দাম বেড়ে গিয়েছিল তিনগুণ।”
অবস্থার ভয়াবহতা বোঝাতে তিনি আরও বলেন—
“মানুষ ঘাস খাচ্ছিল, গাছের পাতা খাচ্ছিল। শিশুরা কাঁদছে খাবারের জন্য, আর বাবা-মায়েরা অসহায়। কেউ চিৎকার করছে, কেউ কান্না করছে, কিন্তু কিছু করার নেই।”
শিশুদের হৃদয়বিদারক আকুতি: ‘আমরা মরতে চাই’
গাজ্জার শিশুদের এই ভয়াবহ মানসিক অবস্থা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। শাইমা আল-ওবাইদি জানান—
“শিশুরা আমাকে বলেছে, তারা মরতে চায়, যেন জান্নাতে গিয়ে অন্তত খেতে পারে। কল্পনা করুন, পাঁচ-ছয় বছরের শিশু জানে না শান্তি কাকে বলে। শুধু জানে ক্ষুধা আর ভয়।”
গাজ্জার বর্তমান অবস্থা শুধু খাদ্য সংকটে সীমাবদ্ধ নয়। পানি, ওষুধ, চিকিৎসা সবকিছুই এখন বিরল হয়ে গেছে। অনেক পরিবার একবেলা খাবারও পাচ্ছে না। হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
মানবিক বিপর্যয়: জাতিসংঘের সতর্কবার্তা
জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা গাজ্জায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা আগেই জানিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা সেই আশঙ্কার চেয়েও ভয়াবহ। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় (OCHA) জানিয়েছে—
“গাজ্জায় এখন যে সংকট চলছে, তা পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। যদি অবিলম্বে ত্রাণ সরবরাহ না করা হয়, তবে গণহারে মৃত্যু ঘটতে পারে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজ্জায় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রায় শেষ। জরুরি অপারেশন করার মতো উপকরণ নেই। শিশুদের অপুষ্টিজনিত অসুস্থতা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
কেন এই অবস্থা হলো?
গাজ্জায় দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরাইলি অবরোধ, চলমান সংঘাত এবং ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া—সবকিছু মিলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গাজ্জা কার্যত একটি খোলা কারাগারে পরিণত হয়েছে। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, পানি ও ওষুধের কোনো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সংকটের জন্য শুধু হামাস বা ইসরাইল নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও দায়ী। তারা নীরবে এই হত্যাযজ্ঞ দেখেছে, প্রতিবাদ করেনি। শাইমা আল-ওবাইদি বলেন—
“যারা এই নৃশংসতা দেখেও চুপ থেকেছে, তারা সমানভাবে দায়ী।”
গাজ্জার মানুষের দৈনন্দিন জীবন কেমন?
বর্তমানে গাজ্জার মানুষ দিন কাটাচ্ছে ভয়, ক্ষুধা আর মৃত্যুর ছায়ায়।
- একবেলার খাবারের জন্য লম্বা লাইন
- পেটের ক্ষুধা মেটাতে ঘাস ও গাছের পাতা খাওয়া
- বাচ্চাদের কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া
- ওষুধের অভাবে সাধারণ রোগেও মৃত্যু
- বাজারে যা আছে, তার দাম আকাশছোঁয়া
একজন স্থানীয় বাসিন্দা জানিয়েছেন—
“আমাদের ফ্রিজ খালি, রান্নার জন্য কিছুই নেই। বাচ্চাদের চোখে পানি ছাড়া কিছু দেখি না।”
বিশ্ব কী করছে?
আন্তর্জাতিকভাবে কিছু ত্রাণ সংস্থা গাজ্জায় সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সীমান্তে অবরোধের কারণে সেগুলো পৌঁছাচ্ছে না। জাতিসংঘের আহ্বান—
“অবরোধ তুলে দিয়ে অবিলম্বে ত্রাণ প্রবাহ শুরু করতে হবে। অন্যথায় গাজ্জা শিগগিরই মানবশূন্য নগরীতে পরিণত হবে।”
কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতা এবং চলমান সংঘাতের কারণে এই আহ্বান এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই সময় গাজ্জার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। প্রতিটি রাষ্ট্র, প্রতিটি মানুষকে এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ ক্ষুধার্ত শিশুর কান্নার চেয়ে ভয়ংকর কিছু নেই।
সংক্ষেপে গাজ্জার সংকটের মূল কারণ:
দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ
যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো
ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা
গাজ্জার শিশুদের মুখ থেকে শোনা—
“আমরা মরতে চাই, যেন জান্নাতে গিয়ে খাবার পাই”
—এ শুধু একটি বাক্য নয়, এটি বিশ্বমানবতার জন্য চরম লজ্জার বিষয়। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী দিনগুলোতে গাজ্জা নামক একটি ভূখণ্ড ইতিহাসে শুধু রক্ত ও অশ্রুর গল্প হয়ে থাকবে।
MAH – 12436 , Signalbd.com