প্রযুক্তি

হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে বিমান

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস তাদের দাপ্তরিক যোগাযোগে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। নিরাপত্তা ও করপোরেট গোপনীয়তা রক্ষার লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির আইটি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। কর্মীদের বিকল্প হিসেবে মাইক্রোসফট টিমস ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেটি আন্তর্জাতিকমানের একটি করপোরেট যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ইতোমধ্যেই বহু সংস্থার মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

নিরাপত্তা ও তথ্য সুরক্ষা—প্রধান বিবেচ্য

বিমানের আইটি বিভাগ থেকে সম্প্রতি জারি করা এক অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করপোরেট নেটওয়ার্কে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস রোধ করাই এই সিদ্ধান্তের মূল উদ্দেশ্য। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, হোয়াটসঅ্যাপ একটি থার্ড-পার্টি অ্যাপ্লিকেশন, যার নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে এই ধরনের অ্যাপে গোপন বা সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে যায়।

হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারে এমনিতেই এনক্রিপশন সুবিধা থাকলেও, দাপ্তরিক কাজে এটি কতটা নিরাপদ—তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে সরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য ব্যবস্থাপনায় এটি কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বহু তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও এই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়েই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।

মাইক্রোসফট টিমস—নতুন করপোরেট মাধ্যম

হোয়াটসঅ্যাপের পরিবর্তে মাইক্রোসফট টিমস ব্যবহারের সুপারিশ করে বিমান জানিয়েছে, এটি দাপ্তরিক যোগাযোগের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ ও কার্যকর একটি প্ল্যাটফর্ম। কর্মীরা ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর বা ইমেইল ব্যবহার করে সহজেই টিমসে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। টিমস-এর মাধ্যমে টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদান, ভয়েস ও ভিডিও কল, ফাইল শেয়ারিং, ক্যালেন্ডার সিনক্রোনাইজেশন এবং মিটিং শিডিউলিংসহ নানাবিধ কার্যকর ফিচার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এসব সুবিধা ব্যবহার করে বিমানের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম আরও সুশৃঙ্খল ও নিরাপদভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে হোয়াটসঅ্যাপ ত্যাগের ধারা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় যারা হোয়াটসঅ্যাপকে দাপ্তরিক কাজ থেকে বাদ দিয়েছে। বিশ্বের বহু নামকরা সরকারি সংস্থা, সামরিক বাহিনী এবং বেসরকারি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে হোয়াটসঅ্যাপের পরিবর্তে নিজেদের উন্নত নিরাপত্তার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ফেসবুকের মালিকানাধীন এই অ্যাপটির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে প্রযুক্তিবিদদের একটি বড় অংশ বহুদিন ধরেই বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

সাইবার হামলা, ফিশিং আক্রমণ, ম্যালওয়্যার ছড়ানো কিংবা করপোরেট তথ্য চুরির আশঙ্কা—এইসব বিষয়গুলোই মূলত হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষ করে থার্ড-পার্টি মডারেশন ও বিদেশি সার্ভারে তথ্য সংরক্ষণের বিষয়টি অনেক সংস্থাকেই চিন্তিত করেছে।

বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়াস

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এই সিদ্ধান্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং তথ্য ব্যবস্থাপনায় অধিক মনোযোগ দেওয়ার সময় এখনই। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেসব মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়, তা যদি যথাযথভাবে সুরক্ষিত না হয় তবে তা দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক উদাহরণ।

কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

এই সিদ্ধান্তের পর কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এ ধরনের পরিবর্তন আধুনিক ও নিরাপদ যোগাযোগকে উৎসাহিত করবে। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, মাইক্রোসফট টিমস ব্যবহারে কিছুটা জটিলতা এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে। এ বিষয়ে বিমানের আইটি বিভাগ থেকে কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ভাবা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিমানের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার অনেকের জন্য সহজ হলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে আমরা আপস করতে পারি না। আমরা চাই, বিমান একটি আধুনিক ও নিরাপদ করপোরেট কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হোক।”

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত শুধু হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতে অন্যান্য যেসব অ্যাপ্লিকেশন নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে, সেগুলোর ব্যবহারও সীমাবদ্ধ করা হতে পারে। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইনট্রানেট প্ল্যাটফর্ম আরও উন্নত করে তা দাপ্তরিক ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে।

উপসংহার

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের এই পদক্ষেপ শুধু একটি অ্যাপ নিষিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার প্রতিফলন। বিশ্বব্যাপী যেখানে তথ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, সেখানে নিরাপত্তার সঙ্গে কোনো আপস না করাই সময়ের দাবি। আশা করা যায়, অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানও এই উদ্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button