প্রযুক্তি কি ডিমেনশিয়া বাড়াচ্ছে? ৫৭টি গবেষণায় উঠে এসেছে বিস্ময়কর সত্য

একুশ শতকে প্রযুক্তি ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। কম্পিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে এআই—সবকিছু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এত প্রযুক্তির ব্যবহার কি মানুষের মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে? বিশেষ করে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বা ‘ডিমেনশিয়া’ বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নটা অনেকের মনে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রযুক্তির সঙ্গে ডিমেনশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার পরিসংখ্যান
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস ও বেলোর ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় ৫৭টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রায় চার লাখ ১১ হাজার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের তথ্য নিয়ে এই গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। অনেকের ধারণার বিপরীতে দেখা গেছে, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমানোও সম্ভব।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার স্মৃতিশক্তি কমায় না বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। “ডিজিটাল ডিমেনশিয়া” নামে যে তত্ত্বটি জনপ্রিয়, তার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি। বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানুষের মস্তিষ্ক আরও সচল ও সক্রিয় থাকে, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় সঠিক ও ফলপ্রসূভাবে।
ডিজিটাল ডিমেনশিয়া কি?
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী ও মনোবিদ ম্যানফ্রেড স্পিৎজার ‘ডিজিটাল ডিমেনশিয়া’ ধারণাটি প্রস্তাব করেন। তার বক্তব্য ছিল, প্রযুক্তির প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বাড়ায় স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আগে আমরা প্রিয়জনের ফোন নম্বর মুখস্থ রাখতাম, এখন তো সেটা স্মার্টফোনে রাখা থাকে। এ কারণে আমাদের মস্তিষ্কের সেই তথ্য ধারণ করার প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মনোযোগ হ্রাস ও দ্রুত বিক্ষিপ্ত হওয়ার প্রবণতাও বাড়ায়।
প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক দিকগুলো
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরণ ও সময়ের উপর স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব পড়ে। যারা সময় কাটান শুধুমাত্র ফেসবুক স্ক্রল করে বা ইউটিউব ভিডিও দেখে, তাদের মস্তিষ্ক তেমন সক্রিয় থাকে না। কিন্তু যারা প্রযুক্তিকে শেখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন, যাঁরা অনলাইন কোর্স, শিক্ষামূলক কন্টেন্টে মনোযোগ দেন, তাঁদের স্মৃতিশক্তি এবং মনোযোগ অনেক বেশি উন্নত থাকে।
শারীরিক ও সামাজিক উপাদানের প্রভাব
গবেষণায় আরও জানা গেছে, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া অনেকটাই নির্ভর করে সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, শারীরিক স্বাস্থ্য, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। প্রযুক্তির সঠিক ও সুষম ব্যবহার হলে শারীরিক ব্যায়ামের পাশাপাশি মস্তিষ্কের জন্য এটি উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বাঁচার পরামর্শ
তবে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে দূরে থাকার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। যেমন—
- দৈনিক কমপক্ষে ২০-২০-২০ নিয়ম পালন করা, অর্থাৎ প্রতি ২০ মিনিট পর পর ২০ সেকেন্ড চোখ স্ক্রিন থেকে সরিয়ে ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তু দেখার চেষ্টা করা।
- প্রযুক্তির ব্যবহারে সীমিত সময় নির্ধারণ করা এবং সময়মতো বিরতি নেয়া।
- প্রযুক্তির মাধ্যমে শেখার সুযোগ কাজে লাগানো, শুধু বিনোদন নয়।
- সামাজিক যোগাযোগ ও বাস্তব জীবনের সম্পর্ক বজায় রাখা।
- অনলাইন গুজব ও ভ্রান্ত তথ্য থেকে সাবধান থাকা।
প্রযুক্তি ও ডিমেনশিয়া: কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রযুক্তি নিজের মতো করে স্মৃতিশক্তির পরিবর্তন ঘটায়। এটি মস্তিষ্ককে কিছু কাজ থেকে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি নতুন ধরনের কাজ শেখায়। যেমন, ফোন নম্বর মুখস্থ রাখার পরিবর্তে তা স্মার্টফোনে রাখা হয়, এতে মস্তিষ্ক অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে মস্তিষ্কের সঠিক ব্যায়াম ও শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রযুক্তি ও মস্তিষ্ক
আগামী দিনে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়বে। এআই, মেশিন লার্নিং, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ইত্যাদি নতুন নতুন প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরও সহজ করবে। এর মধ্যেও প্রয়োজন হবে মানুষের মস্তিষ্কের সক্রিয়তা বজায় রাখা ও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমানো। এজন্য প্রযুক্তি শুধু সময় বাঁচাতে নয়, শেখার সুযোগ হিসেবেও ব্যবহার করা প্রয়োজন।
প্রযুক্তির ব্যবহার ও ডিমেনশিয়ার মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, বরং সঠিক ব্যবহার স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সহায়ক। তবে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ও অযথা ব্যবহার হলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রযুক্তিকে বুঝে শিখে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করাই সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।