জার্মানিতে প্রথম শিল্পভিত্তিক এআই ক্লাউড অবকাঠামো নির্মাণ করবে এনভিডিয়া

সাম্প্রতিক ভিভাটেক সম্মেলনে বিশ্বখ্যাত চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়া তার নতুন ঘোষণা উন্মোচন করেছে—জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করা হবে ইউরোপের প্রথম শিল্পভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ক্লাউড অবকাঠামো। এ পদক্ষেপ কেবল একটি উন্মুক্ত কম্পিউট প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং ভবিষ্যতের “ডিজিটাল কারখানা” তৈরির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
ডিজাইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, সিমুলেশন থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরি অপারেশন ও রোবোটিক্স পর্যন্ত শিল্প ৪.০ এর প্রতিটি স্তরে এনভিডিয়ার নতুন এআই ক্লাউড অবকাঠামো সাহায্য করবে। এই প্ল্যাটফর্মে থাকবে ১০,০০০টি নতুন প্রজন্মের জিপিইউ, যার মধ্যে রয়েছে NVIDIA DGX™ B200 সিস্টেম এবং NVIDIA RTX PRO™ সার্ভারসমূহ । নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হলে জার্মানি হয়ে উঠবে ইউরোপের শক্তিশালী এআই উৎপাদন কেন্দ্র।
প্রধান বিবৃতিঃ জেনসেন হুয়াং
“এখন প্রতিটি শিল্পপতিকে দুই ধরনের কারখানা প্রয়োজন—একটি বাস্তব পণ্য তৈরির, অন্যটি সেই পণ্যের বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলার,” বলেন এনভিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেনসেন হুয়াং। তাঁর ভাষায়, “ইউরোপের প্রথম শিল্পভিত্তিক এআই অবকাঠামো গড়ে তুললে স্থানীয় শিল্পগুলোকে সিমুলেশন-ভিত্তিক, এআই-চালিত উৎপাদনে অগ্রসর হতে সহায়তা করবে।”
হুয়াং এ নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বিস্তারিত উপস্থাপনা করেন, যেখানে তিনি ইউরোপজুড়ে ২০টি “এআই কারখানা” তৈরির পরিকল্পনার খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। এই কারখানাগুলো বড় পরিসরের পরিকাঠামো, উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বাস্তবায়ন প্ল্যাটফর্মের কাজ করবে।
ইউরোপজুড়ে প্রযুক্তি কেন্দ্র সম্প্রসারণ
এ ঘোষণা প্রেক্ষিতে এনভিডিয়া সাতটি দেশে তাদের প্রযুক্তি কেন্দ্র সম্প্রসারণের কথাও জানিয়েছে। ফিনল্যান্ড, জার্মানি, স্পেন, ইতালি, যুক্তরাজ্যসহ সাতটি দেশে এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে কম্পিউট মার্কেটপ্লেসে সরাসরি এক্সেস দেওয়া হবে। ইউরোপীয় সংস্থাগুলো নিজ নিজ ভাষায় এআই মডেল তৈরি এবং উন্নয়নে সহায়তা পাবে, যাতে “স্বপ্রাপ্ত এআই” বা Sovereign AI গড়ে তোলা যায়।
স্মরণীয়, মার্চ মাসে ইউরোপীয় কমিশন $২০ বিলিয়ন বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় চারটি এআই কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনায়। সেই বিনিয়োগের সঙ্গে এনভিডিয়ার উদ্যোগ মিলিত হলে ইউরোপের এআই পরিকাঠামো ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হবে।
কৌশলগত সহযোগিতা ও পার্টনারশিপ
নতুন এআই কারখানায় বিভিন্ন শিল্পখাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার চালিত হবে, যেমন আনসিস (Ansys), ক্যাডেন্স (Cadence) ও সিমেন্স (Siemens)। বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাতা বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, মাসেরাতি, শেফলার এবং ভলভো ইতোমধ্যে এই এনভিডিয়া-চালিত অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারে এগিয়ে।
ফার্মাসিউটিক্যাল দুনিয়ার স্টার নোভো নর্ডিস্কের সঙ্গেও এনভিডিয়া ড্রাগ ডিজকভারি প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে, যেখানে ১৮,০০০টি নতুন সর্বাধুনিক ব্ল্যাকওয়েল চিপ ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া, ইতিমধ্যে এনভিডিয়া ইউরোপীয় এআই স্টার্টআপ মিস্ট্রালের সঙ্গেও যৌথ উদ্যোগ ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
জার্মানিতে প্রকল্পটি চালু হলে এটি চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্জের নতুন সরকারের বড় সাফল্য হিসেবে গণ্য হবে, বিশেষ করে যখন গত বছর ইন্টেল ও উলফস্পিডের স্থানীয় ফ্যাক্টরি স্থগিতের মর্মান্তিক ঘোষণা হয়েছিল।
ইউরোপের দিক থেকে প্রযুক্তিগত দৌড়ে মার্কিন ও চীনের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকা অস্বীকার করেছে হুয়াং, কিন্তু তিনি আশাবাদী যে তারা দ্রুতই সাম্যের লড়াইয়ে ফের পরিস্থিতি সামলে নেবে। “ইউরোপ এখন জেগে উঠেছে—এআই কারখানা ও অবকাঠামোর গুরুত্ব বুঝেছে,” তিনি উল্লেখ করেন।
বার্লিন সফর ও মিটিং
সূত্রের খবর, হুয়াং শুক্রবার বার্লিন সফরে যাচ্ছেন এবং সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ম্যার্জের সঙ্গে বৈঠক করেতে পারেন । বৈঠকে নির্মাণস্থল, ব্যয় ও সময়সূচি নিয়ে সমঝোতা স্থাপনের জন্য আলোচনা হতে পারে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে আপডেট
এআই ছাড়াও হুয়াং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় দিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “কয়েক বছরের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এমন জটিল সমস্যার সমাধান দেবে, যা আমাদের এআই সিস্টেমস এখনো কয়েক বছর ধরেই সম্পাদন করতে ব্যর্থ”।
আগের বার্ষিক সফটওয়্যার ডেভেলপার সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন যে কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসতে ২০ বছর সময় লাগবে, কিন্তু এখন সেই মন্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসেছেন।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
এআই প্রযুক্তি ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগে এনভিডিয়া এবং ইউরোপীয় অংশীদারদের যৌথ উদ্যোগ ইউরোপকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি মানচিত্রে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এনভিডিয়ার ১০ গুণ বৃদ্ধি লক্ষ্য অর্জনে, ডিজিটাল টুইন এবং সিমুলেশন-ভিত্তিক পদ্ধতির গুরুত্ব আর সন্দেহাতীত নয়।
আগামী দুই বছরে এআই কম্পিউটিং সক্ষমতা বাড়াতে এই প্রকল্প, ইউরোপকে স্বনির্ভর “সার্বভৌম এআই”’র পথে অগ্রসর করবে এবং শিল্প খাতকে ডিজিটাল বিপ্লবের মুখে দাঁড় করাবে।