নিবন্ধনের আওতায় আসছে ভ্যাটযোগ্য সব প্রতিষ্ঠান

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের সব ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে, যেসব সুপারশপ, শপিংমল, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ব্যবসা বার্ষিক টার্নওভারের ভিত্তিতে ভ্যাটযোগ্য, তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআর থেকে দেশের সব ভ্যাট কমিশনারেটকে নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে ফেব্রুয়ারিকে ভ্যাট কমিশনারদের নিবন্ধন মাস এবং মার্চকে এনবিআরের ভ্যাট নিবন্ধন মাস ঘোষণা করা হয়েছে।
ভ্যাট নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা ও বর্তমান চিত্র
দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং সরকারি রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট অন্যতম প্রধান উৎস। তবে ১৯৯১ সালে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু হলেও এখনও অনেক ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে। বিশেষ করে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, শপিংমল ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ কৌশলে নিবন্ধনের আওতার বাইরে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ফলে সরকার সঠিকভাবে রাজস্ব পাচ্ছে না।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো হাজার হাজার ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এখনো নিবন্ধন নেয়নি। এটি সরকারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন নির্দেশনা ও ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ
এনবিআর-এর নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে:
- সব ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক নিবন্ধন নিতে হবে।
- সুপারশপ, শপিংমল ও জেলা শহরের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধন করতে হবে, বার্ষিক টার্নওভার নির্বিশেষে।
- মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ধারা ৪ ও ১০ অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
- ভ্যাট কমিশনারদের জন্য ফেব্রুয়ারি মাস নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
- মার্চ মাসে এনবিআর নিবন্ধন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিবন্ধন না করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভ্যাট নিবন্ধন না করলে কী শাস্তি হতে পারে?
যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নেবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাস্তিগুলো হলো:
- জরিমানা: নিবন্ধন না করা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে।
- ব্যবসা পরিচালনায় বাধা: নিবন্ধনবিহীন ব্যবসাকে বেআইনি ঘোষণা করা হতে পারে।
- আইনি ব্যবস্থা: ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জন্য গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ভ্যাট নিবন্ধন পদ্ধতি ও করদাতাদের করণীয়
ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজতর করতে এনবিআর অনলাইন পদ্ধতি চালু করেছে। ব্যবসায়ীরা নিম্নলিখিত ধাপে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারবেন:
- অনলাইন আবেদন: এনবিআরের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে অনলাইন ফর্ম পূরণ করতে হবে।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা: জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক হিসাবের তথ্য এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য নথি প্রদান করতে হবে।
- নিবন্ধন যাচাই ও অনুমোদন: তথ্য যাচাইয়ের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীদের নিবন্ধন নম্বর প্রদান করা হবে।
- ভ্যাট রিটার্ন দাখিল: নিবন্ধনের পর নিয়মিত ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা
ভ্যাট আইনের আওতায় যেসব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- সুপারশপ ও বড় শপিংমল
- হোটেল ও রেস্টুরেন্ট
- ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও মেডিকেল সরঞ্জাম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান
- গাড়ির শোরুম ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান
- শিল্প কারখানা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান
- কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও আবাসন ব্যবসা
- সার্ভিস সেন্টার ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান
ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার এই উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
- একদল ব্যবসায়ী মনে করেন, এটি সরকারি রাজস্ব বাড়াবে এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করবে।
- অনেকে আবার বলছেন, নিবন্ধন প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় নতুন ব্যবসায়ীদের জন্য এটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন এনবিআরের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভ্যাট নীতিতে কিছু ছাড় বা সহজীকরণের আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারের প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করতে সরকার বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা।
- প্রচার ও সচেতনতা কার্যক্রম চালানো, যাতে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট নিবন্ধনের গুরুত্ব বোঝেন।
- নিবন্ধন না করলে কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করা।
- বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ, ব্যবসায়ী সমিতি ও চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে আলোচনা করা।
এনবিআর আশা করছে, ভ্যাট নিবন্ধনের এই উদ্যোগ সফল হলে সরকারের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং কর ফাঁকি বন্ধ হবে।
শেষ কথা
ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা সরকারের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। এটি শুধু রাজস্ব আয় বাড়াবে না, বরং ব্যবসার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। ব্যবসায়ীদের উচিত স্বেচ্ছায় নিবন্ধন গ্রহণ করা এবং নিয়মিত ভ্যাট প্রদান করা। অন্যথায়, কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এনবিআরের এই উদ্যোগ সফল করতে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যাতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।