
খুলনার ফুলতলা উপজেলায় সড়কের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া সেই ফুটফুটে নবজাতককে দত্তক নিতে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে ইতোমধ্যেই ১৫টি আবেদন জমা পড়েছে। এই অসহায় শিশুটি বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে সুস্থভাবে রয়েছে। নবজাতকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মানুষের আগ্রহ ও আবেগ চোখে পড়ার মতো বেড়ে গেছে।
কীভাবে উদ্ধার হলো নবজাতকটি
রোববার ভোরে ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নের মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় সড়কের ধারে শিশুটির কান্নার শব্দ শুনে স্থানীয়রা এগিয়ে আসেন। সোনিয়া বেগম নামের এক গৃহবধূ প্রথম শিশুটিকে দেখতে পান এবং দ্রুত প্রতিবেশী তুলিকে সঙ্গে নিয়ে ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসনীম জাহান ও সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে শিশুটিকে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য নবজাতককে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হাসপাতালেই দত্তক নেওয়ার জন্য ভিড়
খুলনা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শিশুটিকে এক নজর দেখতে হাসপাতাল চত্বরে ভিড় করছেন নানা বয়সী মানুষ। কেউ কেউ শুধু দেখতে এলেও অনেকে আবার সরাসরি দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন।
এক ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার দুই ছেলে। ফেসবুকে মেয়েটির ছবি দেখে স্ত্রীকে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। যদি কেউ না নেয়, আমরা নিতে চাই। ওর জন্য খুব মায়া হচ্ছে।”
দত্তক প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের তৎপরতা
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১৫ জন দত্তক নেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন। প্রক্রিয়াটি আইনগতভাবে সম্পন্ন করতে হবে বলে আগ্রহীদের জেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডের সভাপতির কাছে আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে বোর্ডের সভায় এসব আবেদন পর্যালোচনা করা হবে।
প্রবেশন কর্মকর্তা আবিদা আফরিন জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত শিশুটি খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে থাকবে। যদি সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় লাগে, তবে শিশুটিকে মহেশ্বরপাশার ছোটমনি নিবাসে রাখা হতে পারে।
নবজাতকের স্বাস্থ্যগত অবস্থা
হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান ডা. ফররুখ আহাম্মদ জানিয়েছেন, শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং কোনো জটিলতা নেই। তিনি বলেন, “সঠিক সময়ে হাসপাতালে আনা হয়েছে বলে শিশুটি এখন ভালো আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে রাখব।”
গ্রামীণ এলাকায় নবজাতক ফেলে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন জেলায় রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে নবজাতক পড়ে থাকার ঘটনা দেখা গেছে। সামাজিক অবক্ষয়, দারিদ্র্য বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণকে এসব ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে অনেক সময় এমন অসহায় শিশুর জীবন মানুষের মানবিকতা এবং প্রশাসনের তৎপরতার কারণে বেঁচে যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন
শিশুটির ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মানুষের আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ শিশুটিকে ঘরে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, আবার অনেকে শিশুটির সুস্থতা কামনা করছেন।
স্থানীয়দের মতে, এমন মানবিক উদ্যোগ সমাজে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং অবহেলিত নবজাতকদের বাঁচিয়ে রাখতে আরও মানুষ এগিয়ে আসবে।
শিশুটির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আইনি প্রক্রিয়ার ওপর
এখন সবার দৃষ্টি জেলা শিশু কল্যাণ বোর্ডের দিকে। দত্তক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আইনি নিয়ম মেনে করতে হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। শিশুটির প্রকৃত অভিভাবক পাওয়া না গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে এর আগে যথাযথ যাচাই-বাছাই করা হবে যাতে শিশুটির ভবিষ্যৎ নিরাপদ হয়।
একটি ছোট্ট প্রাণের জন্য মানুষের এই আবেগ সমাজের মানবিক দিকটিকে ফুটিয়ে তুলেছে। নবজাতকের সুরক্ষা ও লালন-পালনের দায়িত্ব যিনি পাবেন, তিনি কেবল একটি শিশুর জীবনই নয়, হয়তো নতুন এক স্বপ্নের জন্ম দেবেন। প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপ ও মানুষের মানবিকতার কারণে এই শিশুর ভাগ্যে নতুন সূর্যের আলো ফুটবে কিনা, তা জানা যাবে অচিরেই।
এম আর এম – ০৫৭৪, Signalbd.com