চকরিয়ার মছনিয়াকাটা রেলক্রসিংয়ে ট্রেন-ট্রাক সংঘর্ষে আহত ২

আজ সকাল সাতটায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মছনিয়াকাটা রেলক্রসিংয়ে ঘটে গেছে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ ট্রেন একটি মালবাহী ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে। এতে ট্রাক চালক ও তার সহকারী গুরুতর আহত হন। আহত দুজনকে উদ্ধার করে প্রথমে চকরিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দুর্ঘটনার সময়কার চিত্র
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা যায়, সকালবেলা ট্রেনটি মছনিয়াকাটা রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রাকটি রেললাইনে উঠে পড়ে। ওই সময় রেলক্রসিংয়ের গেট খোলা ছিল, যার ফলে ট্রাকটি রেলপথে চলে আসে। ট্রেন দ্রুতগতিতে ট্রাকটিকে ধাক্কা দেয়, ফলে ট্রাকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং চালক ও সহকারী গুরুতর আহত হন।
গেটম্যানের অবহেলা দায়িত্বরত ব্যক্তির বক্তব্য
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ছালেকুজ্জামান জানান, রেলক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা গেটম্যান দুর্ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। এই অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই তিনি দাবি করেন। অপরদিকে গেটম্যান মোহাম্মদ শরীফ জানান, তিনি রেলক্রসিং এলাকায় অবস্থান করছিলেন, কিন্তু ওইদিন বৃষ্টি ও সংকেতের সমস্যা থাকার কারণে ট্রেন আসার আগেই দুই পাশের গেট পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেননি। গেট বন্ধ ছিল না যে পাশে ট্রাক উঠেছিল, সেখান থেকে ট্রাক রেললাইনে ঢুকেছিল। দুর্ঘটনার মূল কারণ এটাই বলে তিনি মনে করেন।
রেলওয়ের বক্তব্য ও তদন্তের নির্দেশনা
চকরিয়া রেলওয়ে স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরহাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, বরইতলী রেলক্রসিংয়ে রেলওয়ের সরাসরি কোনো কর্মী দায়িত্ব পালন করেন না। বরং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন এ দায়িত্ব পালন করে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করতে তদন্ত করা হবে।
পুলিশ ও আহতদের অবস্থা
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম জানান, আহত দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের অবস্থা বর্তমানে আশঙ্কাজনক।
চকরিয়া রেলক্রসিং দুর্ঘটনায় পুনরাবৃত্তি না চাই: নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি
এই দুর্ঘটনা আবারও আমাদের সামনে তুলে ধরেছে বাংলাদেশের রেলপথ সুরক্ষায় গেটম্যান ও রেলক্রসিং ব্যবস্থার দুর্বলতা। প্রায়ই রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটার পেছনে রয়েছে গেটম্যানের অবহেলা, সঠিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং সচেতনতার ঘাটতি। মছনিয়াকাটা রেলক্রসিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিশেষ নজরদারি ও আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
কেন বাড়ছে রেলক্রসিং দুর্ঘটনা?
বাংলাদেশে প্রতি বছর রেলক্রসিং দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। মূলত কয়েকটি কারণ দায়ী —
- গেটম্যানদের ঘাটতি ও দায়িত্বহীনতা: অনেক সময় গেটম্যান অনুপস্থিত থাকেন বা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন।
- সঠিক সিগন্যাল ও বাঁধা ব্যবস্থা না থাকা: আধুনিক প্রযুক্তির অভাব রেলক্রসিংয়ে সঠিক সংকেত পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে।
- সড়ক ব্যবহারকারীদের অশিক্ষা ও অসচেতনতা: অনেক সময় চালকরা সতর্ক না হয়ে রেললাইনে প্রবেশ করেন।
- বৃষ্টি, কুয়াশা ও অন্ধকারে নিরাপত্তার অভাব: খারাপ আবহাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চকরিয়া রেলক্রসিং এর মতো এলাকা গুলোতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
সরকার এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে —
- গেটম্যানদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- আধুনিক অটোমেটেড সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন।
- রেলক্রসিং এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য নিয়মিত শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন।
তবে বাস্তবে এসব উদ্যোগ কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মছনিয়াকাটা রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা দেখিয়েছে এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দুর্ঘটনার পর স্থানীয় জনমত ও প্রতিক্রিয়া
স্থানীয়রা জানান, রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। অতীতে এখানে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। তারা দাবি করেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্থানে আধুনিক প্রযুক্তি ও যথাযথ কর্মীদের নিয়োগ করা।
একজন ট্রাক চালক জানান, “আমরা যেভাবে রেললাইনে উঠি, সেখানে গেট বন্ধ না থাকলে দুর্ঘটনার ভয় থাকে সবসময়। কেউ না দেখলে বা কেউ না রুখলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।”
রেলক্রসিং নিরাপত্তায় বিশ্বব্যাপী প্রচলিত কিছু আধুনিক প্রযুক্তি
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা কমাতে নানা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যেমন —
- অটোমেটেড গেট ও সিগন্যাল: যেগুলো ট্রেনের আগমনের সাথে সঙ্গতি রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে।
- সিসিটিভি ও সেন্সর: যেগুলো রাস্তা ও ট্রেনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে বিপদের সংকেত দেয়।
- আলো ও শব্দ সংকেত: যারা পথ পারাপার করতে চায় তাদের সতর্ক করে।
- জিপিএস ও আইওটি প্রযুক্তি: ট্রেন ও যানবাহনের অবস্থান ট্র্যাক করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমায়।
বাংলাদেশেও এসব প্রযুক্তি দ্রুত প্রয়োগ করলে রেলক্রসিং দুর্ঘটনা অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব।
চকরিয়ার মছনিয়াকাটা রেলক্রসিংয়ে ট্রেন ও ট্রাকের সংঘর্ষের এই ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্কবাণী। নিরাপত্তার ঘাটতি ও অবহেলা মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের একযোগে কাজ করে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জনসাধারণকেও রেলক্রসিংয়ে সতর্ক থাকা এবং আইন মেনে চলতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।