জানুয়ারি থেকে ১ হাজারের বেশি ভারতীয়কে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

চলতি বছরে অভিবাসন নীতিতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ১৫৫ জন ভারতীয় নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬২ শতাংশই বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ফেরত গেছেন। এই পরিস্থিতি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন সহযোগিতা, অবৈধ অভিবাসীদের চলমান ফেরত পাঠানো প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার্থী ভিসা নীতিমালার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, “অভিবাসন বিষয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং কেবল সংশ্লিষ্ট নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়ার পরই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়।”
সামরিক উড়োজাহাজে ফিরিয়ে আনা শতাধিক ভারতীয়
২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্য থেকে একটি সামরিক উড়োজাহাজ সি-১৭ করে ১০৪ জন ভারতীয় নাগরিককে ফিরিয়ে আনা হয় ভারতের অমৃতসর বিমানবন্দরে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে উঠে আসে, ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের মধ্যে কিছুজনকে শিকল পরানো অবস্থায় বিমানে ওঠানো হয়েছিল, যা নিয়ে ভারতে নানান বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
তবে ভারত সরকার এ বিষয়ে সরাসরি সমালোচনা না করলেও, কূটনৈতিকভাবে স্পষ্ট করেছে যে নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করেই অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের কড়াকড়ি অভিবাসন নীতি
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে অভিবাসন বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসীদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া অনিয়মিত অভিবাসীদের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নজরদারি বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, ভারত “সঠিক কাজটিই করবে” এবং তার দেশের অনুরোধে অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে নেবে।
১৮ হাজার ভারতীয়কে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন দফতর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, দেশটি এখন পর্যন্ত ১৮ হাজার ভারতীয় নাগরিককে অবৈধভাবে প্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব মানুষ হয়তো বৈধ ভিসা নিয়ে প্রবেশ করলেও নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গিয়ে অবস্থান করেছেন অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছেন।
এই চিহ্নিত নাগরিকদের একটি বড় অংশকে পর্যায়ক্রমে ফেরত পাঠানোর কাজ চলছে। এ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক ফ্লাইটের পাশাপাশি সামরিক উড়োজাহাজও ব্যবহার করছে।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সতর্কবার্তা
২০২৫ সালের মে মাসের শুরুতে ভারতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেও যদি কেউ নির্ধারিত মেয়াদের বেশি অবস্থান করেন, তবে সেটি অভিবাসন আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে তারা ফেরত পাঠানোর ঝুঁকিতে পড়বেন এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধও হতে পারেন।
এই সতর্কবার্তার পর ভারতীয় অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যারা পর্যটন, ব্যবসা বা শিক্ষার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, তারা এখন নিজেদের ভিসার মেয়াদ এবং আইনগত অবস্থান নিয়ে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠেছেন।
শিক্ষার্থী ভিসা নীতিমালায় পরিবর্তন ও উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির পাশাপাশি শিক্ষার্থী ভিসা সংক্রান্ত নীতিতেও পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘোষণা দিয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ভিসা আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এখন থেকে আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়াল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “ভিসা ইস্যু করা একটি সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। তবে আমরা আশা করি, ভারতীয় শিক্ষার্থীদের আবেদন যোগ্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে এবং তারা যথাসময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন।”
যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। জয়সোয়াল জানিয়েছেন, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গেছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ভারতীয় শিক্ষার্থী, যা দেশটিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতের অবস্থানকে শীর্ষে নিয়ে গেছে। এই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা খাত বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব অর্জন করে।
তবে নতুন ভিসা নীতিমালা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির পরিপ্রেক্ষিতে বহু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলো বিবেচনা করছেন।
চীনা শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি নজরদারি
যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতীয় অভিবাসীদের নিয়েই নয়, চীনা শিক্ষার্থীদের ওপরও কড়াকড়ি নীতি প্রয়োগ করছে। সম্প্রতি দেশটি জানায়, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কিংবা সংবেদনশীল বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করার কার্যক্রম চলবে। ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় শিক্ষা বিনিময়েও টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ও শিক্ষাবিষয়ক নীতিতে সাম্প্রতিক কড়াকড়ি বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর অভিবাসীদের জন্য এটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিকভাবে বিষয়গুলোতে সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ভবিষ্যতের অভিবাসন ও শিক্ষা নীতিতে আরও কঠোরতা আসতে পারে—এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের অংশীদারিত্ব ও অভিবাসন সহযোগিতা থাকলেও, এই নতুন পরিস্থিতি উভয় দেশের জন্যই নতুন কৌশল নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।