বাংলাদেশ

২৪ দিনে ১১৪৩ জন বাংলাদেশিকে ঠেলে পাঠাল বিএসএফ, বিজিবির কড়া প্রতিবাদ

ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ গত ২৪ দিনে ১ হাজার ১৪৩ জন বাংলাদেশিকে পুশ ইন (জোরপূর্বক ঠেলে পাঠানো) করেছে বলে নিশ্চিত করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল দিয়ে, যেখানে নিয়ম লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে।

বিজিবি জানায়, ৭ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে দেশের অন্তত ১৮টি সীমান্ত জেলা দিয়ে বিএসএফ এইসব বাংলাদেশি নাগরিককে ঠেলে পাঠিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঠেলে পাঠানো হয়েছে মৌলভীবাজার (৩৮০ জন), খাগড়াছড়ি (১৩২ জন), সিলেট (১১৫ জন), কুড়িগ্রাম (৯৩ জন), এবং লালমনিরহাট (৮৫ জন) সীমান্ত দিয়ে।

কুষ্টিয়ায় আবারও ৯ জনকে ঠেলে পাঠানো

সর্বশেষ পুশ ইন ঘটনা ঘটে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ভাগজোত সীমান্তে। গত শনিবার রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ভারতের জলঙ্গি থানার কাছাকাছি একটি বিএসএফ ক্যাম্প থেকে ৯ জন বাংলাদেশি নাগরিককে সীমান্তের চরাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। সকাল ১০টার দিকে স্থানীয়দের চোখে পড়ে তারা একটি নৌকা থেকে নামছে। পরে বিজিবির টহল দল ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের আটক করে।

জিজ্ঞাসাবাদে আটকরা জানায়, তারা চার বছর আগে অবৈধভাবে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। দীর্ঘদিন ধরে তারা দিল্লিতে ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিল। ঠেলে পাঠানোদের মধ্যে রয়েছে ৪ জন পুরুষ, ২ জন নারী, ২ জন কিশোর এবং ১ জন শিশু।

বিজিবির প্রতিবাদ ও পতাকা বৈঠক

বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, কোনো দেশের নাগরিককে ফেরত পাঠাতে হলে তা নির্ধারিত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই করতে হয়। কিন্তু বিএসএফ একাধিকবার এই প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বাংলাদেশি নাগরিকদের ঠেলে পাঠাচ্ছে, যা সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার পরিপন্থী।

শনিবার সকালে এই ঘটনার পর সীমান্ত পিলার ৮৫/১০-এসের কাছে বিজিবি চরচিলমারী কোম্পানি কমান্ডার ও ১৪৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের জলঙ্গি কোম্পানি কমান্ডারের মধ্যে একটি পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিজিবি লিখিতভাবে এই ঘটনার কড়া প্রতিবাদ জানায়। যদিও বিএসএফ পুশ ইন ঘটনার দায় অস্বীকার করেছে, তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে বলে জানিয়েছে।

কোন কোন সীমান্ত দিয়ে পুশ ইন?

গত ২৪ দিনে বিএসএফ যেসব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশিদের ঠেলে পাঠিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • মৌলভীবাজার: ৩৮০ জন
  • খাগড়াছড়ি: ১৩২ জন
  • সিলেট: ১১৫ জন
  • কুড়িগ্রাম: ৯৩ জন
  • লালমনিরহাট: ৮৫ জন
  • ফেনী: ৫২ জন
  • ঝিনাইদহ: ৫২ জন
  • মেহেরপুর: ৩০ জন
  • পঞ্চগড়: ৩২ জন
  • চুয়াডাঙ্গা: ১৯ জন
  • ঠাকুরগাঁও: ১৯ জন
  • দিনাজপুর: ১৫ জন
  • সাতক্ষীরা: ২৩ জন
  • হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া: মিলিয়ে ৮০ জনেরও বেশি।

বিজিবির সতর্ক অবস্থান

বিজিবি জানিয়েছে, বিএসএফের এই ধরনের একতরফা সিদ্ধান্ত মোকাবিলায় সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল জোরদার করা হয়েছে। যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বিজিবি। একই সঙ্গে বিএসএফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তোলার চিন্তাভাবনাও চলছে বলে জানা গেছে বিজিবি সূত্রে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা

বিএসএফ যেভাবে কোনো রকম প্রক্রিয়া ছাড়াই নারী, শিশু ও কিশোরসহ বাংলাদেশি নাগরিকদের ঠেলে পাঠাচ্ছে, তা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন সীমান্ত বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারায় এ ধরনের একতরফা পুশ ইন কার্যক্রম স্পষ্টতই উদ্বেগজনক। শুধু সীমান্ত এলাকায় নয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ফলে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে উভয় দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে। এ ছাড়া যারা ফিরে এসেছেন, তাদের পুনর্বাসন এবং মানবিক সহায়তার বিষয়টিও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিবেচনা করা জরুরি।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button