অর্থনীতি

পুলিশের জন্য ২০০ নতুন গাড়ি কিনছে সরকার, ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে আগুনে পুড়ে যাওয়া ও ভাঙচুরের শিকার পুলিশ বাহিনীর যানবাহন পুনঃস্থাপনের অংশ হিসেবে নতুন করে ২০০টি ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি কিনছে বাংলাদেশ সরকার। এ গাড়িগুলোর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭২ কোটি টাকা। প্রতিটি গাড়ির মূল্য হবে ৮৬ লাখ টাকা। এই ক্রয় পরিকল্পনার মাধ্যমে পুলিশের অপারেশনাল সক্ষমতা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির গতকালের বৈঠকে এই প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হয়।

গাড়ি ক্ষয়ক্ষতির বিশাল অঙ্ক: ৩৬০ কোটি টাকার ক্ষতি

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-আন্দোলনের সময় মোট ১,০৫৯টি পুলিশ যানবাহন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিংবা ভাঙচুরের কারণে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ৫২৬টি গাড়ি আগুনে পুড়ে যায় এবং ৫৩৩টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা।

সেই সময়কার ঘটনায় দেশের ৪৬০টি থানায় ও বিভিন্ন পুলিশ স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১০৫টি থানায় সরাসরি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। জননিরাপত্তা বিভাগ এই বিষয়গুলো উল্লেখ করে অর্থ বিভাগের কাছে গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে চিঠি পাঠিয়েছিল।

ক্রয় প্রক্রিয়া ও উৎস

নতুন ২০০টি ডাবল কেবিন পিকআপ গাড়ি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে কেনা হচ্ছে। এটি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে এই ব্যয় নির্বাহ করা হবে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেনা হওয়ায় প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি এরই মধ্যে গত ২৯ এপ্রিল নীতিগতভাবে এই প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছিল। এরপর ৫ জুনের ক্রয় কমিটির বৈঠকে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।

অর্থ উপদেষ্টার মন্তব্য

বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “পুলিশের অনেক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও বাহিনীর চলাচল সক্ষমতা পুনর্গঠনে গাড়িগুলো জরুরি ভিত্তিতে কেনা হচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, ঢাকার আশপাশে পুলিশের জন্য একটি হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণের চিন্তাও করা হচ্ছে, যাতে বাহিনীর সদস্যদের আবাসন সমস্যা কমানো যায়।

পুলিশের গাড়ির সামগ্রিক চাহিদা ও পরিকল্পনা

পুলিশ সদর দপ্তরের মতে, গাড়ি সংকট দূর করতে তাদের দরকার:

  • ৩৮টি জিপ
  • ২৫০টি ডাবল কেবিন পিকআপ
  • ৫৬টি সিঙ্গেল কেবিন পিকআপ
  • ২টি প্যাট্রল কার
  • ২টি মাইক্রোবাস
  • ২টি অ্যাম্বুলেন্স
  • ২০টি ট্রাক
  • ২টি বাস
  • ১২টি প্রিজন ভ্যান
  • ২৮৫টি মোটরসাইকেল
  • ৮টি রেকার
  • ৪টি এপিসি (Armoured Personnel Carrier)
  • ১টি জলকামান

মোট ৭২২টি যানবাহন প্রয়োজন হলেও যাচাই-বাছাই শেষে এই সংখ্যা কমিয়ে ২০০টি গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

ঈদের ছুটির আগে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, ক্রয় কমিটির ৫ জুনের বৈঠকের পূর্ব নির্ধারিত আলোচ্যসূচিতে এই প্রস্তাবটি ছিল না। ঈদের ছুটির আগের দিন হঠাৎ করেই প্রস্তাবটি টেবিলে উপস্থাপন করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদনও পায়।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) ইনামুল হক সাগর বলেন, “পুলিশের অনেক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দফায় ২০০ গাড়ি কেনার অনুমোদন পাওয়া গেছে, যা নিঃসন্দেহে বাহিনীর কাজের সক্ষমতা বাড়াবে।”

পুলিশের ভাবমূর্তি ও গণআন্দোলনের প্রভাব

জুলাইয়ের আন্দোলনে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা-পদস্থ ব্যক্তি অপেশাদার, ক্ষমতালিপ্সু ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন—এমন অভিযোগে মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় এই তথ্য উঠে এসেছে। বলা হয়, জনমানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা পুলিশের যানবাহন ও স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালায়।

বাজেট থেকে অর্থায়ন

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট থেকেই এই গাড়িগুলোর ব্যয় নির্বাহ করা হবে। অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, বাজেটে এ খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও অগ্রগতি

অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির জন্য এখনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের অন্যান্য যানবাহন সংগ্রহের প্রস্তাবের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইনামুল হক সাগর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পুলিশ বাহিনীর জন্য ২০০টি নতুন গাড়ি কেনার এই উদ্যোগ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে গতি আনবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নতুন করে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। গণআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং ভবিষ্যতে সংঘাত-পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই সিদ্ধান্তকে সরকার জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button