ক্রিকেট

‘চোকার্স’ শব্দটা আর শুনতে চায় না দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের দীর্ঘ দিনের কাঁটা ‘চোকার্স’ লেবেল আজ ধুয়ে গেছে অনবদ্য এক জয় দিয়ে। ২৭ বছর পর আইসিসি কোনো বড় টুর্নামেন্ট জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা আজ বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লর্ডসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে, মাত্র ৬৯ রান দরকার ছিল আর হাতে ছিল ৮ উইকেট। বেশিরভাগের দৃষ্টিতে এটা সহজ একটা জয়, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ছিল জীবনের বড় পরীক্ষা।

‘চোকার্স’ লেবেল: এক কষ্টকর ইতিহাস

১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দল বারবার বড় সুযোগে চাপে ভেঙে পড়ার জন্য পরিচিত ছিল। আইসিসির বিভিন্ন বিশ্বকাপ এবং টুর্নামেন্টে ১২ বার সেমিফাইনালে উঠে, একবার ফাইনাল খেলেও তারা কখনোই শিরোপা জিতে উঠতে পারেনি। সেই কারণেই ক্রিকেটবিশ্ব তাদের ‘চোকার্স’ নামে ডাকে, মানে চাপের মুখে ভেঙে পড়ে যাওয়া দল।

বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত ও অন্যান্য বড় প্রতিপক্ষের কাছে অন্তত একাধিকবার লজ্জাজনকভাবে হেরে যাওয়া, বোলিং ও ব্যাটিংয়ে বড় মুহূর্তে মনোযোগ হারানো—সব মিলিয়ে এই ‘চোকার্স’ লেবেল তাদের কাঁধে বসেছিল অনেকদিন।

ফাইনালের দিন: মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং জয়ের গল্প

১৪ জুন, লর্ডসের ঐতিহাসিক ময়দানে শেষ দিন শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়েরা ‘চোকার্স’ শব্দ দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে মানসিক চাপ দিতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল, ‘৬০ রানের কমে ৮ উইকেট হারাবে দক্ষিণ আফ্রিকা’। এই মন্তব্য শুনে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা বলেন, “আমি স্পষ্ট শুনেছি এটা। কিন্তু আমাদের মনোযোগ হারাতে দেওয়া যাবে না।”

বাভুমা ও এইডেন মার্করাম জুটি গড়ে দিনশেষে ৬৯ রান সংগ্রহের লক্ষ্যে অটল অবস্থান তৈরি করেন। বিশেষ করে মার্করাম ছিলেন নির্ভরযোগ্য, ১৩৬ রান করে ম্যাচসেরার সম্মান লাভ করেন। বাভুমা যদিও ৬৬ রান করেই আউট হন, কিন্তু তার মনোবল এবং নেতৃত্ব ছিল দলের জয়ের মূল চাবিকাঠি।

মার্করামের আবেগঘন কথা

ম্যাচ শেষে মিডিয়াকে দেওয়া বক্তব্যে মার্করাম বলেন, “‘চোকার্স’ শব্দটা আমরা আর শুনতে চাই না। ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্মৃতি আমাকে বারবার ভাবিয়েছে, তখন আমরা মাত্র ৭ রানে হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ব্যর্থতা আমাকে শক্তি দিয়েছে আজকের জয়ের জন্য।”

তার ভাষায়, “আগে যেমন চাপের মুখে ভেঙে পড়তাম, আজ সেটি হয়নি। আমরা লর্ডসের ব্যালকনিতে যখন ট্রফি হাতে তুলে নিই, তখন বুঝলাম আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়েছে। এই দলের জন্য এটা এক নতুন যুগের শুরু।”

ইতিহাসের মোরগ

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ছিল একটি মাইলফলক, যেখানে তারা প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে শক্তিশালী প্রমাণ করেছিল। কিন্তু এরপরের সব বড় টুর্নামেন্টে বড় পর্যায়ে আসার পরও তারা ধরা পড়েছে মানসিক দুর্বলতায়। আজ সেই ‘দুর্বলতা’ কাটিয়ে তারা নতুন ইতিহাস গড়েছে।

লর্ডসের ঐতিহাসিক ময়দান, যেখানে ক্রিকেটের বহু কিংবদন্তি খেলেছে, আজ সেই ময়দানেই দক্ষিণ আফ্রিকা ঘোষণা করল তাদের নতুন পরিচয়: দমনের শক্তিশালী মনোবল আর জয়ের অপরাজেয় দল।

ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

বিশ্বের বহু ক্রিকেট বিশ্লেষক ও প্রাক্তন খেলোয়াড়রা আজ দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের প্রশংসা করেছেন। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকা আজ প্রমাণ করল চাপ মোকাবেলার জন্য তারা প্রস্তুত এবং তাদের মধ্যে এখন নতুন আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়েছে।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু শিরোপা জেতেনি, বরং তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে একটা বদল এসেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা

অধিনায়ক বাভুমা ও টিম ম্যানেজমেন্ট ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, এই সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আরও বড় টুর্নামেন্টে বিজয়ী দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে কাজ করবে দল। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং—সব বিভাগেই নতুন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।

বিশেষত তরুণ খেলোয়াড়দের মানসিক প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আবার কখনো ‘চোকার্স’ লেবেল লেগে না থাকে।

২৭ বছর পর আইসিসি শিরোপা জয়, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কঠিন লড়াই, এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপের মোকাবিলা করেই দক্ষিণ আফ্রিকা আজ এক নতুন ইতিহাস রচনা করল। ‘চোকার্স’ শব্দটি তাদের অতীত, আর তাদের ভবিষ্যৎ এখন জয়ের পথে উজ্জ্বল।

সিগনালবিডি এই সাফল্যের গল্প নিয়ে গর্বিত এবং দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এটাই হলো অনুপ্রেরণার একটি মহান গল্প।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button