বিশ্ব

মসজিদ নেই, মুসলমান নেই এরকম ভারত চাই: ইয়াতি নারসিংহনন্দ

ভারতের কেরালা প্রদেশে উগ্র হিন্দুত্ববাদী পূজারি ইয়াতি নারসিংহনন্দ সম্প্রতি এক সংহতি সমাবেশে এমন উগ্র মন্তব্য করেছেন যে তা দেশজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তুলেছে। তিনি বলেন, “মসজিদ, মাদ্রাসা ও মুসলিমরা যাতে না থাকে—এমন ভারত চাই।” এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয় কেরালার হাই কোর্ট জংশনের নিকটবর্তী ভাঞ্চি স্কোয়ার এলাকায় বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনে। এতে শতাধিক উগ্র হিন্দুত্ববাদী পুরুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইয়াতি নারসিংহনন্দ সাফরন চাদর পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত ছিলেন এবং উগ্র ভাষায় হিন্দুদের জন্য “নিজস্ব দেশ” প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।

হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি

ইয়াতি নারসিংহনন্দ তার বক্তব্যে বলেন, “বিশ্বে খ্রিস্টানদের ১০০টির বেশি দেশ রয়েছে, মুসলমানদের ৫৭টি দেশ এবং ইহুদিদের একটি দেশ। আমরা ১০০ কোটি হিন্দু, কিন্তু আমাদের কোনও রাষ্ট্র নেই। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপদ জীবন, আমাদের ধর্মের রক্ষা।”

তিনি আরও বলেন, “মহাত্মা গান্ধী এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু হিন্দুদের নিজেদের জমি প্রতিষ্ঠা করতে বাধা দিয়েছেন। সনাতন ধর্মের বিরোধীদের আমরা ভয় পাই না; আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার—একটি হিন্দুপ্রধান ভারত।”

উগ্র হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক মতামত

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়াতি নারসিংহনন্দের বক্তব্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের দিকগুলো নিয়ে উগ্রবাদীরা প্রায়শই বিতর্কিত মন্তব্য করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মসজিদ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইয়াতি নারসিংহনন্দের মতো নেতাদের উগ্র মন্তব্য সামাজিক সামঞ্জস্য ও ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।

নাগরিক সমাজের প্রতিক্রিয়া

ইয়াতি নারসিংহনন্দের উক্তি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই মন্তব্যকে ‘সম্প্রদায়িক বিদ্বেষে উদ্বুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কেরালার বিভিন্ন শহরে নাগরিকরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছে এবং ধর্মীয় সহনশীলতার আহ্বান জানিয়েছে।

এছাড়া, মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক নেতাও এই বক্তব্যের নিন্দা করেছেন। তারা বলেন, “এই ধরনের বক্তব্য ভারতের সংবিধানের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ এবং সহমর্মী সমাজের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।”

রাজনৈতিক প্রভাব ও সম্ভাব্য উত্তেজনা

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইয়াতি নারসিংহনন্দের মন্তব্য সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, ধর্মীয় সহিংসতা বা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক কার্যক্রম আইনত দণ্ডনীয়। এমন মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে এবং নির্বাচনী পর্যায়ে বিভাজনের সৃষ্টি করতে পারে।

পাশাপাশি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই ধরনের উগ্র বক্তৃতার প্রভাব কমাতে সচেতন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেরালার পুলিশ ইতিমধ্যেই সতর্কতা জারি করেছে এবং সামাজিক শান্তি রক্ষায় অতিরিক্ত নজরদারি বাড়িয়েছে।

ইতিহাসে হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি

ইতিহাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কিছু হিন্দু নেতাও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তবে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু ধর্মনিরপেক্ষ ভারত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, ইয়াতি নারসিংহনন্দের দাবি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন এবং আধুনিক ভারতের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব

যদি এই ধরনের বক্তব্য অব্যাহত থাকে, তা শুধু দেশের ভিতরে নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবাধিকার রক্ষায় অগ্রগামী দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। তাই সাম্প্রদায়িক উগ্রতার ঘটনা আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য হুমকি হিসেবে ধরা হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের সব নাগরিকের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সমাজে সমন্বয় ও শান্তি বজায় রাখতে শিক্ষা ও সচেতনতা কর্মসূচি কার্যকর হতে পারে।

ইয়াতি নারসিংহনন্দের উগ্র মন্তব্য ভারতের সমাজে বিতর্ক ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। ভারতের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।

ইয়াতি নারসিংহনন্দের বক্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভারতের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমীকরণে। তবে বিভিন্ন পক্ষই আশা করছে, দেশের মানুষ সংবিধান ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ ও সমন্বিত সমাজ গড়ে তুলবে।

MAH – 12816  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button