বাংলাদেশ

পাবনায় গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে ভেজাল দুধের ঘটনা পরিকল্পিত: প্রাণ-আরএফএল

পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের প্রাণ ডেইরির গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে গত ২১ জুলাই ভেজাল দুধ পাওয়া যায়। স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে দুধে ডিটারজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের তিন কর্মকর্তা ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। তবে প্রাণ-আরএফএল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা ‘পরিকল্পিত’ বলে দাবি করেছেন।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব তদন্তে আবিষ্কার করেছে, দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের দুধ সরবরাহের দায়ে দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রের কিছু কর্মী এবং স্থানীয় এক সংঘবদ্ধ চক্র এই কেলেঙ্কারিটি সংঘটিত করেছে। তারা দুধে ডিটারজেন্ট মেশিয়ে প্রাণ ডেইরির সুনাম নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়েছে।

ঘটনার পেছনের কারণ ও তদন্তের অগ্রগতি

রোববার বিকেলে প্রাণ ডেইরির প্রধান কার্যালয়, বাড্ডায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিস্তারিত বক্তব্য দেন। উপস্থিত ছিলেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান, জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তৌহিদুজ্জামান, বিপণনপ্রধান সৈয়দ মুস্তায়িন কাদেরসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রটি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। আমরা একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রাণ ডেইরিকে দুধ সরবরাহকারী একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”

তিনি আরও জানান, তিনজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও পাঁচজন দুধ সরবরাহকারী খামারির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

প্রাণ ডেইরির কঠোর দুধ গুণমান নিয়ন্ত্রণ ও কর্মী ব্যবস্থা

কামরুজ্জামান কামাল বলেন, “গত এক বছরে দুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে প্রাণ ডেইরি ২৭ জন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেছে। তদুপরি, ২৮৩ জন দুধ সরবরাহকারী খামারির কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ করা হয়েছে। গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ায় প্রায় ২৭ লাখ লিটার দুধ বাতিল করা হয়েছে। প্রধান সংগ্রহ কেন্দ্রে প্রাথমিক বাছাইয়ের মাধ্যমে ৪২ হাজার লিটার দুধ বাতিল করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, প্রাণ ডেইরি সবসময় নিবন্ধিত এবং নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের আগে চার ধাপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। তাই নিম্নমানের দুধ প্রধান প্রক্রিয়াজাতকেন্দ্রে পৌঁছানোর সুযোগ নেই।

আধুনিক প্রযুক্তি ও মনিটরিং বৃদ্ধির পদক্ষেপ

প্রাণ ডেইরি সম্প্রতি গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ প্রক্রিয়া আরো কঠোর করেছে। প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষার অবকাঠামো উন্নত করা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। গ্রামীণ সংগ্রহ কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে এবং খামারিরা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, “আমরা প্রায় ১৬ হাজার খামারির সঙ্গে সরাসরি কাজ করি। তাদের জন্য অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে গোখাদ্য এবং টিকা সরবরাহ করি। আমরা কয়েকজন মধ্যস্বত্বভোগীকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি, যারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের ওপর এই পরিকল্পিত হামলা চালিয়েছে।”

তিনি আরো যোগ করেন, “আমরা শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের জন্যও উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন করি। তাই আমাদের ওপর পরিকল্পিত হামলা জাতির ক্ষতি ছাড়া কিছু নয়। আমরা এই অপপ্রচারে কোনওভাবে পিছপা হব না।”

দুধে ভেজাল: বাংলাদেশের দুধ শিল্পে বড় সমস্যা

বাংলাদেশে দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে গুণগত মান ও নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রগুলোতে দুধের মান নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে নানান সমস্যা দেখা দেয়। দুধে ভেজাল মেশানোর ঘটনা শুধু প্রাণ-আরএফএল নয়, দেশের বিভিন্ন দুধ সরবরাহকারীর ক্ষেত্রেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুধে ভেজাল মেশানো বা নিম্নমানের দুধ সরবরাহ করলে শুধু মানুষের স্বাস্থ্যই ঝুঁকিতে পড়ে না, দেশের দুধ শিল্পের সুনামও নষ্ট হয়। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।

ভেজাল দুধ নির্মূলের জন্য প্রয়োজন কঠোর আইন ও প্রযুক্তি

সরকারি এবং বেসরকারি খাতে দুধ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কঠোর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা একাধিকবার উঠে এসেছে। গ্রামীণ পর্যায়ে দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।

দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন প্রাণ-আরএফএল, তেমনি সরকারকেও মিলেমিশে কাজ করতে হবে, যাতে দুধ উৎপাদন ও সরবরাহে অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যায়।

প্রাণ-আরএফএল’র প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

পাবনায় ঘটে যাওয়া এই দুধে ভেজালের ঘটনা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের জন্য একটি জোরালো সতর্কতা। প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তা নিয়ে কোনও আপস করবে না বলে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তারা গ্রামীণ দুধ সংগ্রহ প্রক্রিয়া আরো বেশি উন্নত করার পাশাপাশি সরবরাহকারীদের মনিটরিং ও নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। পাশাপাশি, দুধ সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের দুধ শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করবে।

MAH – 12257 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button