রাজশাহীতে শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ

বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাজশাহীতে বাস শ্রমিকদের ডাকা কর্মবিরতির কারণে ঢাকাগামী সব যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে সাধারণ যাত্রীরা চরম অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছেন। শহরের শিরোইল বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন যাত্রীসেবা কেন্দ্র এখন জনমানবশূন্য অবস্থায় আছে।
কোন কোন পরিবহন বন্ধ
ন্যাশনাল ট্রাভেলস, দেশ ট্রাভেলস, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, গ্রামীণ ট্রাভেলস এবং শ্যামলী ট্রাভেলসের শ্রমিকরা এই কর্মবিরতিতে অংশ নিয়েছেন। রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টা থেকে কর্মবিরতি শুরু হয়ে সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালেও অব্যাহত থাকে। তবে একতা পরিবহনসহ কয়েকটি লোকাল পরিবহন এখনও চলাচল করছে।
শিরোইল বাস টার্মিনালে ঢাকাগামী কাউন্টারগুলোতে দেখা গেছে, ন্যাশনাল, দেশ, হানিফ, গ্রামীণ ও শ্যামলীর কাউন্টারে কোনো বাস টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ যাত্রীরা বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন।
যাত্রীদের ভোগান্তি
সাইদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, “হঠাৎ খবর পেয়ে আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। দুপুরে বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম সব বাস বন্ধ। অন্য যেসব বাস চলছিল, সেগুলোর টিকিটও পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছি।”
এ ধরনের পরিস্থিতিতে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। অনেকেই অজানা সময়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন, আবার অনেকে ট্যাক্সি বা প্রাইভেট ভ্যান ভাড়া করে যাতায়াত করছেন।
শ্রমিকদের দাবিসমূহ
শ্রমিকরা বলেন, বর্তমান বেতন অত্যন্ত নিম্ন। একটি আপ-ডাউন ট্রিপে চালক মাত্র ১২০০ টাকা, হেলপার ৬০০ টাকা, এবং সুপারভাইজার খুবই কম বেতন পান। তিনজন স্টাফের খাবারের জন্য ১০০ টাকা বরাদ্দ, যা অনেক কম।
তাদের মূল দাবিসমূহ হলো:
- একটি আপ-ডাউন ট্রিপে চালকের বেতন ২০০০ টাকা
- হেলপারের বেতন ১০০০ টাকা
- সুপারভাইজারের বেতন ১১০০ টাকা
- খাবারের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা
- হোটেল ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা
- প্রতিবছর বোনাস প্রদানের নিশ্চয়তা
বাসচালক লিটন বলেন, “আমাদের বেতন এত কম যে মাসে এক কেজি গরুর মাংস খেতেও কষ্ট হয়। সন্তানদের পড়ালেখা করানো কি সম্ভব?”
ন্যাশনাল ট্রাভেলসের হেলপার রেজা জানান, “একটি ট্রিপ থেকে আমার হাতে খরচ বাদে আসে মাত্র ৪০০ টাকা। মাসে সর্বোচ্চ ১৪টি ট্রিপ করলে আয় হয় মাত্র ৫৬০০ টাকা। এই আয় দিয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন।”
মানববন্ধন ও আন্দোলন
শ্রমিকরা দুপুর ১২টার দিকে শিরোইল বাসস্ট্যান্ডে মানববন্ধন করেন। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে তারা নানা স্লোগান দেন এবং সমর্থকদেরকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানান।
রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পাখি বলেন, “শ্রমিকরা ন্যায্য বেতনের জন্য আন্দোলন করছেন। মালিকপক্ষ মাত্র ১০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, যা শ্রমিকরা মেনে নেননি। আমরা মালিকদের সঙ্গে আবারও আলোচনায় বসবো এবং দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে নিশ্চিত পদক্ষেপ নেব।”
মালিকপক্ষের বক্তব্য
মালিকপক্ষ জানায়, শ্রমিকদের দাবির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে শ্রমিকরা বলছেন, গত ১০ বছর ধরে বেতন বৃদ্ধি হয়নি। ২৩ আগস্ট বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
বাস চলাচলের বর্তমান পরিস্থিতি
শহরের বিভিন্ন লোকাল বাস চলাচল অব্যাহত থাকলেও ঢাকাগামী বাসগুলো বন্ধ থাকায় যাত্রীরা বিকল্প পরিবহন খুঁজছেন। বিশেষ করে সকাল ও দুপুরের সময় যাত্রীরা খুবই ভোগান্তিতে পড়েছেন।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় বাসপথের যাত্রীরা সচেতন হয়ে উঠেছেন। অনেকে ট্যাক্সি, প্রাইভেট ভ্যান ও রেলপথে ভ্রমণ করছেন। তবে রাজধানী ও রাজশাহীর যাতায়াতের জন্য এটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে যাত্রী পরিবহন খাতে শ্রমিকদের বেতন ও কল্যাণের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকেই আলোচনার বিষয়। দেশের বিভিন্ন শহরে একই ধরনের ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটছে। শ্রমিকরা দীর্ঘ সময় কাজ করে নিম্ন বেতনে জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ধরনের আন্দোলন শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শ্রমিকদের দাবির সঙ্গে মালিকপক্ষের সামঞ্জস্য না থাকলে নিয়মিত এই ধরনের পরিবহন ব্যাহত ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে সরকারের পর্যবেক্ষণ ও নীতিগত সমাধান জরুরি।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
- শ্রমিকদের বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ
- ট্রিপ অনুযায়ী ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিতকরণ
- খাদ্য ও ভাতা সংক্রান্ত সুবিধা বৃদ্ধি
- বার্ষিক বোনাস ও স্বাস্থ্য বীমা প্রদানের উদ্যোগ
এই ধরনের পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং যাত্রী সেবা নিয়মিত চলবে।
রাজশাহীতে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বিষয়ক আন্দোলন এখন শহরের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদে পরিণত হয়েছে। ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ যাত্রীদের জন্য এটি বিশাল সমস্যা তৈরি করেছে। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া সম্ভব।
রাজশাহী ও ঢাকার যাত্রীরা আশা করছেন, মালিকপক্ষ দ্রুত সমস্যার সমাধান করবে এবং বাস চলাচল স্বাভাবিক হবে।
MAH – 12706, Signalbd.com