বিশ্ব

জেরুজালেমে প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো মাজার দখল করে বাড়িতে রূপান্তর করেছেন এক ইসরায়েলি

জেরুজালেম শহরে অবস্থিত প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো একটি ইসলামি ঐতিহাসিক নিদর্শন—শেখ আহমেদ আল-দাজানির মাজার—সম্প্রতি এক ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর দখলে চলে গেছে। তিনি মাজারটিকে নিজস্ব বাড়ি হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছেন, যা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্থানীয় ফিলিস্তিনি প্রশাসন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিয়োজিত মহল।

জেরুজালেম গভর্নরেটের গণমাধ্যম দপ্তর বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তি মাজারটির মূল তালা ভেঙে ফেলে ভেতরে প্রবেশ করেন এবং সেখানে নিজের আসবাবপত্র স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি নতুন তালা লাগিয়ে দেন, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ স্থাপন করেন এবং মাজারের ঐতিহাসিক কাঠামোর ভেতরে থাকা পবিত্র কবর ও বাইরের দেয়ালে সংযুক্ত পরিচিতি ফলক সরিয়ে ফেলেন।

মাজারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

শেখ আহমেদ আল-দাজানির মাজারটি জেরুজালেম শহরের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে নির্মিত এ মাজারটি কেবল একটি ধর্মীয় স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং এটি মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল। দাজানি পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এই মাজারের দেখভাল করে আসছে। পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত মাজার পরিদর্শন করতেন এবং এর পবিত্রতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতেন।

দখলের ঘটনা ও প্রতিক্রিয়া

মাজারের দায়িত্বে থাকা দাজানি পরিবারের এক সদস্য নিয়মিত পরিদর্শনের সময় মাজার দখলের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। এতে হতবাক হয়ে পরিবারটি ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেম পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করে। অভিযোগের ভিত্তিতে পৌর কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বুধবার ওই ইসরায়েলি ব্যক্তিকে মাজার থেকে সরিয়ে দেয়। তবে এর পরও দাজানি পরিবারের কাছে মাজারের নতুন চাবি হস্তান্তর করা হয়নি, যা নিয়ে পরিবারটি চরম উদ্বিগ্ন।

জেরুজালেম গভর্নরেট এই পদক্ষেপকে পরিবারটির ‘ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে। তারা জানায়, “এই ঘটনা মাজারের নিয়ন্ত্রণ দাজানি পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র এবং ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অংশ, যার মাধ্যমে জেরুজালেমের ইসলামি ও খ্রিষ্টান পরিচয় মুছে ফেলা হচ্ছে।”

আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

জেরুজালেম গভর্নরেট এ ঘটনাকে ‘পূর্ণমাত্রার অপরাধ’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, “ইসরায়েলি দখলদার কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে জেরুজালেমের আরব, ইসলামি ও খ্রিষ্টান পরিচয়কে ধ্বংস করার জন্য একের পর এক অপরাধমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ আহমেদ আল-দাজানির মাজার দখল করা তারই সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত।”

গভর্নরেট আরও অভিযোগ করে যে, এমন ঘটনাগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটানো হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ দাবি

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জেরুজালেম গভর্নরেট জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো), ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি দ্রুত হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের দাবি, “জেরুজালেমে অবস্থিত ইসলামি ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর সুরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি এখন সময়ের দাবি।”

জেরুজালেমের দখল ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালে ছয়দিনব্যাপী আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর থেকে শহরের অনেক মুসলিম ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় স্থাপনায় ইসরায়েলি হস্তক্ষেপ বেড়েছে। ইসরায়েল এসব স্থাপনাকে ‘পুরনো শহরের অংশ’ দাবি করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে অবৈধ দখল হিসেবে গণ্য করে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবাদ সত্ত্বেও ইসরায়েল সেখানে বসতি স্থাপন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য ব্যাপক উদ্বেগের কারণ।

সাংস্কৃতিক নিধনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাজার দখলের এই ঘটনাটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনাকে ঘিরে নয়, বরং এটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক নিধনের অংশ। এটি এমন একটি কৌশল যার মাধ্যমে মুসলমানদের জেরুজালেমে ঐতিহাসিক উপস্থিতি ও দাবি দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে ধর্মীয় উত্তেজনা ও সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিশ্লেষক।

উপসংহার

শেখ আহমেদ আল-দাজানির মাজার দখলের ঘটনা জেরুজালেমে ইসরায়েলি নীতির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। এই দখল শুধু একটি ধর্মীয় নিদর্শনের অপমান নয়, এটি একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে এ ধরনের ঘটনাগুলো আরও ঘন ঘন ঘটতে পারে এবং এতে জেরুজালেমের বহু শতাব্দীর সহাবস্থান ও বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। উন্নয়ন ও ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে এই খাতকে আরও শক্তিশালী করছে। আগামী দিনে এই ধরনের আয়োজন এই শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button