
চণ্ডিগড়ের ব্যাটিং স্বর্গে যখন দুই দল মিলে তুলল ৪৩৬ রান, তখনও যশপ্রীত বুমরা ছিলেন অনন্য। ২২ গজে চারদিক থেকে বাউন্ডারি–ছক্কার বৃষ্টি হলেও বুমরার বল যেন এক অন্য ছন্দে নাচছিল। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের জয়ের মূল কারিগর ছিলেন তিনি—শুধু উইকেট নয়, রান আটকে, চাপ সৃষ্টি করে এবং মোক্ষম সময় উইকেট তুলে নিয়ে।
গতকাল আইপিএলের এলিমিনেটর ম্যাচে গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে ২০ রানে জয় পেয়েছে মুম্বাই। প্রথমে ব্যাট করে ২২৮ রান তুলেছিল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। বিশাল লক্ষ্য সামনে রেখে গুজরাটও জবাব দিচ্ছিল দারুণভাবে। ১৩ ওভারেই তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৪৮/২। ম্যাচ তখন একরকম গুজরাটের মুঠোয়। কিন্তু তখনই বল হাতে তুলে নেন যশপ্রীত বুমরা—দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অস্ত্র।
দারুণ এক ইয়র্কারে ওয়াশিংটন সুন্দরকে বোল্ড করে ভেঙে দেন তাঁর ও সাই সুদর্শনের ৮৪ রানের জুটি। ওই ওভারে মাত্র ৪ রান দেন বুমরা। এরপর ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। গুজরাট আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ২০৮ রানে গুটিয়ে যায় হার্দিক পান্ডিয়ার দল।
টানা চাপ তৈরি করেন বুমরা
বুমরার অবদান শুধু ওই এক ওভারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মাত্র ৪ রান দিয়ে শুরু করেন তিনি। পাওয়ারপ্লেতে ফিরেও দেন কেবল ১১ রান। এরপর যখন দলের সবচেয়ে কঠিন সময়ে তাঁকে আনা হয়, তখনও তিনি দেখান ধৈর্য, দক্ষতা ও নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ।
চূড়ান্ত মুহূর্তে, যখন গুজরাটের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৩ রান শেষ তিন ওভারে, তখন বুমরা দিয়ে দেন মাত্র ৯ রান। গড়ে ১১.২০ রানে রান উঠলেও বুমরার ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৬.৭৫। এমন কিপটে বোলিং টি-টোয়েন্টির আধুনিক যুগেও বিরল।
বুমরাকে নিয়ে প্রশংসার ঝড়
ম্যাচের পর ভারতের সাবেক পেসার বরুণ অ্যারন ক্রিকইনফোর টাইমআউটে বলেন,
‘আপনার উইকেট দরকার হলে সে এনে দেবে, রান আটকে দেওয়ার দরকার হলেও সে পারে। সে একধরনের ভ্যাকসিন, যা যেকোনো বোলিং দলের অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে পারে।’
এই মন্তব্য যেন পুরো ম্যাচের সারমর্ম। বুমরা ছিলেন একাধারে অস্ত্র, প্রতিরোধ এবং নির্ভরতার নাম।
আকাশ চোপড়ার ভাষ্য ছিল আরও কাব্যিক,
‘সে একটা ব্রহ্মাস্র, একটা জিনিয়াস। এমন বোলার আর একজনও নেই, সৃষ্টিকর্তা আর কাউকে এমন করে বানাননি।’
টম মুডির বিশ্লেষণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই কোচ বলেন,
‘টি-টোয়েন্টিতে এমন বোলার বিরল, যার ওভারে রান তোলা অসম্ভব না হলেও খুব কঠিন। দলগুলোকে ২০ ওভারের ম্যাচ মূলত ১৬ ওভার ধরে খেলতে হয়, কারণ বুমরার ৪ ওভারে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।’
অধিনায়কের ভরসার নাম বুমরা
মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া ম্যাচ শেষে বলেন,
‘যখনই মনে হয় ম্যাচ আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, আমি বুমরাকে বোলিংয়ে আনি। বুমরার ওভার মুম্বাই শহরের বাড়ির মতো—অমূল্য।’
বুমরার এমন ধারাবাহিকতা এবং চাপের মুহূর্তে আত্মবিশ্বাস মুম্বাই ইন্ডিয়ানসকে ভরসা দেয়। তিনি শুধুই একজন বোলার নন, বরং একজন কৌশলগত সম্পদ।
পরিসংখ্যানে বুমরার শ্রেষ্ঠত্ব
চার ওভারে ২৭ রান, ১ উইকেট। পরিসংখ্যান হয়তো খুব জাঁকজমকপূর্ণ নয়, কিন্তু পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁর প্রভাব ছিল বিশাল। ১৩ ওভারে ১৪৮ রান তুলেও যখন গুজরাট ম্যাচ হেরে যায়, তখন বোঝা যায় বুমরার স্পেল কতটা ম্যাচের গতিপথ বদলে দিয়েছে।
এই ম্যাচে মোট ছয়জন বোলার ব্যবহার করেন হার্দিক। এর মধ্যে কেবল বুমরার ইকোনমিই ৭–এর নিচে। বাকি সবাই গড় ১০-এর উপরে রান দেন। যেখানে সব বোলারকে খুনে ব্যাটারদের দাপটের সামনে অসহায় মনে হচ্ছিল, সেখানেই বুমরা ছিলেন সাহস, পরিকল্পনা এবং পারফরম্যান্সের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।
ফাইনালে চোখ মুম্বাইয়ের
গুজরাটকে হারিয়ে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে পা রেখেছে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। আগামীকাল ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ পাঞ্জাব কিংস। ইতোমধ্যে ফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু।
মুম্বাইয়ের সামনে এখন সুযোগ নিজেদের ইতিহাসে আরেকটি আইপিএল শিরোপা জয়ের। এই যাত্রায় বুমরা থাকবেন দলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা—এই কথায় কোনো সন্দেহ নেই।
উপসংহার
যশপ্রীত বুমরার মতো ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স শুধু পরিসংখ্যানে ধরা যায় না। তাঁর প্রতিটি স্পেল একটি পরিকল্পনা, প্রতিটি ডেলিভারি একটি কৌশল। তিনি যেন বল হাতে এক চিকিৎসক, যিনি প্রতিপক্ষের শক্তিকে দুর্বল করে দেন নিখুঁত ওষুধ প্রয়োগে। যেমনটা বলেছেন বরুণ অ্যারন,
‘সে একধরনের ভ্যাকসিন, যা যেকোনো বোলিং দলের যেকোনো অসুস্থতা সারিয়ে তুলতে পারে।’
মুম্বাইয়ের এই অস্ত্রই কি তাদের ফাইনালে পৌঁছে দেবে? উত্তর পেতে অপেক্ষা আর একদিন।