পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে ৬ যানবাহনের ভয়াবহ সংঘর্ষ, আহত ১৫

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে পদ্মা সেতু উত্তর থানার সামনের প্রধান সড়কে সংঘটিত এই দুর্ঘটনায় ছয়টি যানবাহন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ও সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল তিনটি যাত্রীবাহী বাস, একটি জিপ, একটি প্রাইভেটকার এবং একটি অটোরিকশা। ইমাদ পরিবহনের একটি বাস ব্রেক ফেল করার পরপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রথমে একটি প্রাইভেটকারে ধাক্কা দেয়, তারপর একে একে জিপ, আরও দুটি বাস ও একটি অটোরিকশায় ধাক্কা মারে।
সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে ভয়ংকর মুহূর্ত
সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দ্রুত গতির বাসটি একের পর এক গাড়িকে ধাক্কা দিচ্ছে। ইলিশ পরিবহনের একটি বাস অটোরিকশার উপর উঠে গেলে সেটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন অটোরিকশার চালকসহ আরও বেশ কয়েকজন যাত্রী।
ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মানুষ ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। নেটিজেনরা এমন মর্মান্তিক ঘটনা দেখে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন—পদ্মা সেতুর আশপাশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য।
“আরেকটু হলে প্রাণে মেরে ফেলতো” — বললেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্থানীয় এক অটোচালক জানান, “ভাগ্য ভালো, আজ সেতু এলাকায় খুব বেশি ভিড় ছিল না। না হলে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারত।”
এক আহত যাত্রী জানান, “আমি বুঝতেই পারিনি কীভাবে বাসটি আমাদের গাড়িতে ধাক্কা মারল। চোখের সামনে গাড়িগুলো একের পর এক উল্টে যেতে দেখেছি। এখনো গায়ে ব্যথা অনুভব করছি।”
প্রতিদিন বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি: অব্যবস্থাপনার অভিযোগ স্থানীয়দের
স্থানীয়রা জানান, পদ্মা সেতুর আশেপাশের সড়কে প্রতিদিনই উচ্চগতির যান চলাচল এবং যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাব থাকায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এর আগেও এই এলাকায় একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় দোকানি মো. সালাউদ্দিন বলেন, “আমরা বারবার বলেছি—এই এলাকায় গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্পিড ব্রেকার, সিসিটিভি মনিটরিং বাড়াতে হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনো ঘুমিয়ে আছে।”
পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর থেকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের যানবাহনের গতি এবং চাপ অনেক বেড়েছে। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুর্ঘটনার সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পদ্মা সেতু উত্তর থানার পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাওয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং আশপাশের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পদ্মা সেতু উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জাকির হোসেন বলেন, “আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করি। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাসচালক ও হেলপার পলাতক
ইমাদ পরিবহনের বাসচালক ও হেলপার দুর্ঘটনার পরপরই পালিয়ে যায়। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের শনাক্ত করে আটকের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
সড়ক নিরাপত্তায় জবাব চাই জনগণের
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইওয়েগুলিতে স্পিড মনিটরিং, জরুরি রেসপন্স ইউনিট এবং সুশৃঙ্খল পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
বিশিষ্ট সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. শামসুল হক বলেন, “এই ধরনের বড় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে গঠনমূলক নীতিমালা দরকার। প্রতিটি বড় মোড়ে ট্রাফিক সিগনাল, স্পিড ক্যামেরা ও নিয়মিত টহল নিশ্চিত করতে হবে।”
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের গর্ব, কিন্তু তার আশপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এমন দুর্ঘটনা বারবার আমাদের ব্যথিত করে। একদিকে বিশাল উন্নয়ন, অন্যদিকে তাতে জড়িত মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ—এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সময় এসেছে কর্তৃপক্ষের গা-ছাড়া মনোভাব পরিবর্তনের। দুর্ঘটনার তদন্ত হোক স্বচ্ছ ও দ্রুত, এবং সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা হোক দৃঢ় ও আধুনিক।