আল–আজহারের ইমামকে চাপ দিয়ে ই’স’রাইলবি’রো’ধী বিবৃতি প্রত্যাহার করালো মিশর

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আল–আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম আহমদ আল–তায়েবকে চাপ দিয়ে গাজা পরিস্থিতি নিয়ে দেওয়া ইসরায়েলবিরোধী বিবৃতি প্রত্যাহার করিয়েছে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসির সরকার। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং আল–আজহারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিবৃতিটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের নির্দেশে তা সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়।
ইসরায়েলবিরোধী বিবৃতি কেন প্রত্যাহার
গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর চলমান যুদ্ধ, অবরোধ ও মানবিক সংকটের তীব্র নিন্দা জানিয়ে সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছিল কায়রোভিত্তিক আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে অনাহার চাপিয়ে দেওয়ার’ অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক চাপের মুখে আল–আজহার কর্তৃপক্ষ বিবৃতিটি প্রত্যাহার করে জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কোনো ধরনের প্রভাব না ফেলতেই এই সিদ্ধান্ত।
প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সরাসরি চাপ
আল–আজহারের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানায়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট সিসির কার্যালয় থেকে গ্র্যান্ড ইমাম আহমদ আল–তায়েবকে ফোন করে বিবৃতিটি সরিয়ে নিতে বলা হয়। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ওই বিবৃতিটি মুছে ফেলা হয়।
যদিও আল–আজহার কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে বলছে, মানবিক দিক বিবেচনা করে তারা নিজেরাই বিবৃতিটি প্রত্যাহার করেছে যাতে আলোচনাগুলো ব্যাহত না হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে দাবি উঠেছে যে এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক চাপের ফল।
গাজায় মানবিক বিপর্যয় ও ক্ষুধার্ত মানুষের চিত্র
গাজায় চলমান অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি ও ওষুধের মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে সেখানে অন্তত ২১ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে। গত কয়েক মাসে অনাহারে ও অপুষ্টিতে মারা গেছে শতাধিক ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই শিশু। শুধু গত সপ্তাহেই গাজায় খাদ্যাভাবজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ২৯ জনে পৌঁছেছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই নতুন নতুন শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে ভর্তি হচ্ছে।
আল–আজহারের অবস্থান এবং বিরল পদক্ষেপ
আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুতে সতর্ক অবস্থান নেয়। কিন্তু গাজার মানবিক বিপর্যয়ের কারণে তারা এবার সরাসরি ইসরায়েলের সমালোচনা করে বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, গাজায় অনাহার ও রক্তপাত বন্ধ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এই বিবৃতি সরিয়ে নেওয়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এত বড় একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন রাজনৈতিক চাপে তাদের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে গেল?
মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
‘ইন্টারন্যাশনাল মুসলিম স্কলার্স ইউনিয়ন’-এর প্রধান আলী আল–কারদাগি বিবৃতিটি সরিয়ে নেওয়াকে ‘মানবিক বিবেকের কণ্ঠরোধ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “গাজাকে রক্ষার জন্য যে কণ্ঠ আল–আজহার তুলেছিল, সেটি বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এটি নীরবতা ও সহমতের এক দৃষ্টান্ত, যা মানবতা ও ধর্মীয় দায়িত্বের পরিপন্থী।”
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠনও এ ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেছে। অনেকের মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ মিসরের কূটনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনা
ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মিসরের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। নেদারল্যান্ডসে একদল মানবাধিকার কর্মী মিসরের দূতাবাসের সামনে শিকল বেঁধে বিক্ষোভ করেছেন, গাজার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ রাখার প্রতিবাদ জানাতে। তাদের অভিযোগ, মিসরের এই নীরবতা ও নীতি ইসরায়েলের জন্য পরোক্ষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
পরবর্তী পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গাজার চলমান সংকটের প্রেক্ষিতে আল–আজহারের বিবৃতি সরিয়ে নেওয়া ভবিষ্যতে আরও বিতর্ক তৈরি করতে পারে। মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়বে বলে তারা মনে করছেন। আর এই ঘটনাটি মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ ঐক্যে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।
এম আর এম – ০৫৫৪, Signalbd.com