এবার চীনা শিল্পাঞ্চল দখল করল আরাকান আর্মি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) তাদের অভিযানের মাধ্যমে দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ দখলের পর এবার তারা কিয়াউকফিউ বন্দরের কাছে চীনের অর্থায়নে পরিচালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল দখল করেছে। এই ঘটনা মিয়ানমারের সামরিক শাসনের উপর গভীর চাপ সৃষ্টি করেছে এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই অভিযানে জান্তা সরকারের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিহত এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেলসহ বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য আটক হয়েছেন, যা বিদ্রোহীদের কৌশলগত শক্তির প্রমাণ বহন করে।
কিয়াউকফিউ শিল্পাঞ্চলের গুরুত্ব
কিয়াউকফিউ বন্দর মিয়ানমারের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে এই অঞ্চলে তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, শোধনাগার, এবং গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো চীনের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো তাদের ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার এবং এশিয়ার শক্তি বাজারে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়। আরাকান আর্মির এই শিল্পাঞ্চল দখল চীনের বিনিয়োগের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে পারে।
‘দ্য ইরাবতী’ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরাকান আর্মি কিয়াউকফিউ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পিয়াং সি কে এলাকায় জান্তা সরকারের একটি সেনা ব্যাটেলিয়নের সদর দফতর ঘিরে ফেলেছে। কিয়াউকফিউ-রাম্রি জাতীয় সড়কের পাশে অবস্থিত পিয়াইন সি কাই জনপদও তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদিও শহরের একটি সেনা ব্রিগেড এখনও প্রতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছে, তবে বিদ্রোহীদের আক্রমণের তীব্রতা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের তেল শোধনাগারের কাছাকাছি এলাকায় বিদ্রোহীরা এখনও প্রবেশ করেনি, তবে তাদের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
সামরিক ক্ষয়ক্ষতি
এই অভিযানে আরাকান আর্মির হামলায় জান্তা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিহত হয়েছেন, এবং চলতি সপ্তাহের শুরুতে স্নাইপার হামলায় ১১ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার কিয়াও মিও আউং এবং একজন সেনা ক্যাপ্টেন নিহত হন। শুক্রবার তাদের মরদেহ হেলিকপ্টারে ইয়াঙ্গুনে পাঠানো হয়। এছাড়া, লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিয়াও লিন কিয়াইং-সহ বেশ কয়েকজন সেনা সদস্যকে আরাকান আর্মি আটক করেছে। এই ঘটনাগুলো জান্তা সরকারের সামরিক শক্তির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে।
আরাকান আর্মির কৌশল
আরাকান আর্মির এই সাফল্য তাদের কৌশলগত দক্ষতা এবং সংগঠিত পরিকল্পনার ফল। তারা ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’-এর অন্যতম শরিক হিসেবে কাজ করছে, যেখানে তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) রয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া ‘অপারেশন ১০২৭’ এই জোটের প্রধান অভিযান, যা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। এছাড়া, চিন ন্যাশনাল আর্মি (সিএনএ), চায়নাল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), এবং ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের পিপল্স ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা এবং মণিপুর সীমান্তবর্তী চিন প্রদেশের অধিকাংশ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির সহযোগিতায় তারা এই অঞ্চলগুলোতে তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এছাড়া, ইয়াও ডিফেন্স ফোর্স, ইয়াও আর্মি, এবং মনিওয়া পিপল্স ডিফেন্স ফোর্সের মতো সহযোগী গোষ্ঠীগুলো জান্তা বিরোধী অভিযানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
ইয়াঙ্গুনের দিকে অগ্রগতি
কিয়াউকফিউ শিল্পাঞ্চল দখলের পাশাপাশি আরাকান আর্মি ইয়াঙ্গুনের কাছে থান্ডওয়ে নৌঘাঁটি এবং গাওয়া শহর দখল করেছে। পিয়াং সি কে এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাদের ইয়াঙ্গুনমুখী অভিযানের জন্য কৌশলগত সুবিধা এনে দিয়েছে। ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমারের বাণিজ্যিক ও প্রাক্তন রাজধানী হিসেবে, দেশটির অর্থনীতি ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। এই অঞ্চলের দখল বিদ্রোহীদের জন্য একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হতে পারে, যা জান্তা সরকারের ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে দেবে।
চীনের ভূমিকা
চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ এই অঞ্চলে গভীরভাবে জড়িত। কিয়াউকফিউ বন্দর এবং এর শিল্পাঞ্চল চীনের বিআরআই প্রকল্পের একটি প্রধান অংশ। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় এমএনডিএএ জান্তা সরকারের সঙ্গে একটি সংঘর্ষবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, আরাকান আর্মি এই চুক্তিতে অংশ নেয়নি। তাদের অব্যাহত অভিযান চীনের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির এই অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষের ধোঁয়া বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত থেকে দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা সীমান্ত নিরাপত্তায় কোনো ছাড় দেবে না এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন কোনো কার্যক্রমে জড়াবে না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি সরকারকে উৎখাত করে। এরপর থেকে দেশটিতে সামরিক শাসন চলছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে আরাকান আর্মি, টিএনএলএ, এবং এমএনডিএএ-এর সমন্বয়ে গঠিত ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু করে। এই অভিযানের মাধ্যমে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আরাকান আর্মির এই অগ্রগতি মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। ইয়াঙ্গুনের দিকে তাদের অভিযান জান্তা সরকারের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। এছাড়া, চীনের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয়টিও এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।