বানিজ্য

ইলন মাস্কের ১২ সন্তান ও ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্প

বিশ্বের অন্যতম সফল প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। তিনি শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্যই নয়, ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবার নিয়েও প্রায়শই আলোচনায় থাকেন। তার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ বদলে দিচ্ছে, আর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বড় একটি পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। চলুন, ইলন মাস্কের জীবন, সাফল্যের পথচলা, ব্যবসায়িক কৌশল ও পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।

প্রথম জীবন ও শিক্ষা

ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালের ২৮ জুন, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহরে। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে নিজের তৈরি একটি ভিডিও গেম বিক্রি করে ৫০০ ডলার আয় করেন। এই ঘটনার মাধ্যমেই তার উদ্যোক্তা মানসিকতার সূচনা হয়।

পরবর্তীতে, তিনি কানাডায় পড়াশোনার জন্য যান এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে ভর্তি হলেও মাত্র দুই দিনের মধ্যে তা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসার পথে নামেন

উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা

Zip2: প্রথম সফল উদ্যোগ

১৯৯৬ সালে, ইলন মাস্ক তার ভাই কিমবল মাস্কের সঙ্গে Zip2 নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সংবাদপত্র ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ডিজিটাল মানচিত্র ও গাইডলাইন সরবরাহ করত। ১৯৯৯ সালে Compaq কোম্পানি এটি কিনে নেয় এবং মাস্ক লাভ করেন ৩০৭ মিলিয়ন ডলার

PayPal: ডিজিটাল লেনদেন বিপ্লব

Zip2 বিক্রির পর, তিনি X.com নামে একটি অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান চালু করেন, যা পরে PayPal নামে পরিচিত হয়। এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ২০০২ সালে eBay এটি কিনে নেয় ১.৫ বিলিয়ন ডলারে

স্পেসএক্স: মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন

২০০২ সালে, ইলন মাস্ক SpaceX (স্পেসএক্স) প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল মহাকাশ ভ্রমণকে সহজ ও কম খরচে সম্ভব করা। প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি ব্যর্থতার সম্মুখীন হলেও ২০০৮ সালে Falcon 1 রকেট সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে, যা স্পেসএক্সের যাত্রাকে নতুন মাত্রা দেয়।

SpaceX-এর কিছু বড় অর্জন:

  • ২০১২ সালে Dragon ক্যাপসুলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (ISS) সরবরাহ পাঠানো
  • ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো রকেট ল্যান্ডিং করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা
  • ২০২০ সালে NASA-র নভোচারীদের Crew Dragon-এর মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো
  • ২০২৩ সালে Starship মহাকাশযান তৈরি, যা ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্য স্থির করেছে

টেসলা: বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপ্লব

২০০৪ সালে, ইলন মাস্ক টেসলা মোটরস-এ বিনিয়োগ করেন এবং পরে এর প্রধান নির্বাহী হন। তখন বৈদ্যুতিক গাড়ি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু তার নেতৃত্বে Model S, Model 3, Model X, Model Y-এর মতো বৈদ্যুতিক গাড়িগুলো বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ঘটায়

বর্তমানে, টেসলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সৌরশক্তি ও ব্যাটারি প্রযুক্তিতেও কাজ করছে, যা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছে।

পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন

ইলন মাস্কের ব্যক্তিগত জীবনও তার ব্যবসার মতোই আলোচিত। ৫২ বছর বয়সি মাস্কের মোট সন্তান ১২ জন

প্রাক্তন স্ত্রী ও প্রথম সন্তানরা

ইলন মাস্ক ২০০০ সালে লেখিকা জাস্টিন উইলসনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ছয়টি সন্তান ছিল।

  • তাদের প্রথম সন্তান নেভাডা আলেক্সান্ডার ২০০২ সালে জন্ম নেন। তবে মাত্র ১০ সপ্তাহ বয়সে সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিন্ড্রোম (SIDS)-এ মারা যান
  • এরপর, ২০০৪ সালে যমজ সন্তান ভিভিয়ান ও গ্রিফিন জন্মগ্রহণ করেন
  • ২০০৬ সালে তারা তিন সন্তান কাই, স্যাক্সন ও ড্যামিয়ানকে স্বাগত জানান
  • ২০০৮ সালে মাস্ক ও উইলসনের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
ইলন মাস্কের পরিবার

গ্রিমসের সঙ্গে সম্পর্ক

২০১৮ সালে, মাস্ক কানাডিয়ান গায়িকা গ্রিমস (আসল নাম ক্লেয়ার বাউচার)-এর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তাদের তিনটি সন্তান রয়েছে—

  • ২০২১ সালে তাদের ছেলে এক্স এ-এক্সআইআই জন্মগ্রহণ করে
  • ২০২২ সালে সারোগেটের মাধ্যমে তাদের মেয়ে এক্সা ডার্ক সিডেরেল জন্ম নেয়
  • একই বছর, তারা আরও একটি ছেলে সন্তানের বাবা-মা হন, যার নাম টেকনো মেকানিকাস

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, গ্রিমস এক্স-এ (পূর্বে টুইটার) লিখেছিলেন, তিনি চান যে তিনি যাতে দেখাতে পারেন তার ছোট্ট টেকনো কতটা সুন্দর, তবে তার অগ্রাধিকার এখন তার বাচ্চাদের জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখা। এ সময় তিনি তাদের গোপনীয়তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানান।

শিভন জিলিসের সঙ্গে যমজ সন্তান

২০২১ সালে, মাস্ক তার কোম্পানি নিউরালিংকের শীর্ষ নির্বাহী শিভন জিলিসের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তাদের ঘরে যমজ ছেলে-মেয়ে জন্ম নেয়। দীর্ঘদিন এই তথ্য গোপন রাখা হলেও পরে প্রকাশ পায়, তাদের ছেলের নাম স্ট্রাইডার এবং মেয়ের নাম অ্যাজুরে। নিউইয়র্ক পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, তাদের তৃতীয় সন্তানের নাম এখনো প্রকাশ করা হয়নি

ইলন মাস্কের সাফল্যের মূল কারণ

১. ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা

তিনি বিশ্বাস করেন, “যদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে আপনি ব্যর্থতার ভয় না করেই সেটি করুন।”

২. উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা

তার প্রতিটি উদ্যোগ নতুন কিছু করার চেষ্টা করে, যা প্রযুক্তির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

৩. কঠোর পরিশ্রম ও লক্ষ্যনির্ধারণ

মাস্ক প্রতিদিন ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজ করেন এবং ভবিষ্যত নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা করেন।

৪. বড় স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা

তিনি শুধু ব্যবসায়িক লাভের কথা চিন্তা করেন না, বরং ভবিষ্যৎ মানবজাতির উন্নতির জন্য কাজ করেন।

৫. সমস্যা সমাধানের দক্ষতা

তিনি যে কোনো সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন এবং সমাধানের জন্য কাজ করেন।

ইলন মাস্ক শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ী নন, বরং তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, উদ্ভাবক এবং দূরদর্শী নেতা। তার প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রযুক্তির গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি এক বিশাল পরিবারের অভিভাবক। তার জীবন থেকে শেখার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো— ঝুঁকি নেওয়া, কঠোর পরিশ্রম করা এবং নতুন উদ্ভাবনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button