বিশ্ব

ভারতের মুসলমানদের কেন বারবার দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হয়

ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি সংঘটিত একটি প্রাণঘাতী হামলার পর দেশজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণার নতুন ঢেউ শুরু হয়েছে। হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেম বারবার সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে, এবং তাঁদের নিজেকে “বিশ্বস্ত নাগরিক” প্রমাণ করতে হচ্ছে বারবার।

হামলার জেরে মুসলিমবিদ্বেষের উত্থান

গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। এর প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যেই দিল্লিভিত্তিক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস (APCR) দেশজুড়ে ১৮৪টি মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত করে। এ ঘটনাগুলোর অর্ধেক ছিল বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সংক্রান্ত এবং বাকিগুলোর মধ্যে ছিল ভয় দেখানো, শারীরিক হামলা, হয়রানি, দোকানপাটে ভাঙচুর, হুমকি, গালিগালাজ ও এমনকি তিনটি হত্যার ঘটনাও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রবণতা কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল নয়, বরং ভারতের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় মুসলমানদের পরিচয়কে নিয়ে একটি মৌলিক পুনঃসংজ্ঞায়নের চেষ্টার অংশ।

অভিযান ও সন্দেহের রাজনীতি

হামলার পর ভারত সরকার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে সামরিক অভিযান চালায়। পাকিস্তানকে এ হামলার জন্য দায়ী করে সীমান্তবর্তী এলাকায় লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট করে আক্রমণ চালানো হয়। যদিও পাকিস্তান দায় অস্বীকার করে, তবুও ভারতীয় সরকার এ অভিযানের মাধ্যমে নিজেদের ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ রক্ষাকারী হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু এর পরিণতিতে ভারতের অভ্যন্তরে নতুন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিতে শুরু করে। তাঁদের বসবাসের এলাকা ‘মিনি পাকিস্তান’ নামে পরিচিতি পায়, যা তাঁদের সামাজিকভাবে পৃথক করে দেওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ।

দেশপ্রেমের শর্ত ও লাঞ্ছনার রাজনীতি

বিশ্লেষক সারা আথার বলেন, “মুসলমানদের শুধু ভারতকে সমর্থন করলেই চলবে না, তাঁদের জোরালোভাবে পাকিস্তানের নিন্দাও করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “এটা দেশপ্রেম নয়, বরং একধরনের সামাজিক লাঞ্ছনা। সাংবাদিকেরা কাশ্মীরি ও ভারতীয় মুসলমানদের সামনে জোর করে মাইক্রোফোন ধরেন—তাঁদের মুখ থেকে ‘পাকিস্তানের নিন্দা’ শুনতেই হবে।”

এই বাস্তবতা প্রতিনিয়ত ভারতীয় মুসলমানদের এক ধরনের অঘোষিত আনুগত্য পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। শুধু চুপ করে থাকা বা নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়। বরং পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় ঘৃণা প্রকাশ না করলে তাঁরা ‘সন্দেহভাজন’ হয়ে পড়েন।

ইতিহাস ও বিদ্বেষের পুনরাবৃত্তি

ভারতীয় লেখক হুসেন হায়েদরি বলেন, “ভারতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। দশকের পর দশক ধরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় মুসলমানদের মানসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মূল্য চোকাতে হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, ভারতের কিছু অংশে মুসলমানদের ‘পাকিস্তানি’ হিসেবে অবজ্ঞা করা, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে তাঁদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে উপহাস করা, এমনকি ‘পাকিস্তানে চলে যাও’—এ ধরনের কথা বলা একটি সাংস্কৃতিক কাঠামোর অংশ, যা বহু আগেই গড়ে উঠেছে।

বিচারহীনতা ও রাজনীতির নীরবতা

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা প্রায় নীরব রয়েছেন। বিরোধী দলগুলোও খুব একটা মুখ খুলছে না। কারণ, তাঁরা জানেন, মুসলমানদের পক্ষে কথা বললে জনসাধারণের একাংশের ঘৃণা এবং সরকারের নজরদারির শিকার হতে পারে। এই নীরবতার সুযোগে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি হরিয়ানার আম্বালায় কিছু কট্টরপন্থী লোক একযোগে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে মুসলমানদের দোকানে আগুন দেয়। এটি কোনো তাৎক্ষণিক সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ নয়; বরং সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত একটি হামলা, যা ভারতীয় সমাজে মুসলমানদের সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণের একটি প্রতীকী দৃষ্টান্ত।

মৃত্যু ও বিদ্বেষের রাজনীতি

ভারতের এক রাজ্যে চলতি মাসের শুরুতে এক মুসলিম ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন, কারণ এক সাংবাদিক তাঁকে জনসমক্ষে ‘পাকিস্তানি’ আখ্যা দিয়ে লাঞ্ছিত করে। এই ঘটনা দেখায়, কেবল সন্দেহের ভিত্তিতেই একজন মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া কত সহজ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থার জন্ম রাজনৈতিক ভাষণ, মিডিয়া বিতর্ক, অনলাইন হিংসা ও পাঠ্যপুস্তকে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ঘৃণার ভিত্তিতে।

জাতীয়তাবাদের রূপান্তর: স্বীকৃত মুসলমান বনাম সন্দেহভাজন মুসলমান

সারা আথার বলেন, “জাতীয়তাবাদ এখন বর্জনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। নির্ধারণ করা হচ্ছে কে ‘গ্রহণযোগ্য মুসলমান’, আর কে নন। বার্তা স্পষ্ট—আপনি যদি সমাজে থাকতে চান, তবে আপনাকে নির্দ্বিধায় সব জাতীয়তাবাদী মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। না হলে আপনি সন্ত্রাসবাদী, পাকিস্তানপন্থী বা আরও খারাপ কিছু বিবেচিত হবেন।”

এই মানসিকতা সামাজিক সম্প্রীতির বিপরীতে কাজ করে, এবং দীর্ঘমেয়াদে একটি জাতিগোষ্ঠীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবকে পুষ্ট করে তোলে।

মুসলমানদের নাগরিকত্ব কি শর্তসাপেক্ষ?

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে হয়তো অস্ত্রের গর্জন আপাতত স্তিমিত, কিন্তু ভারতীয় মুসলমানদের পরিচয় ও অধিকার নিয়ে যে যুদ্ধ, তা এখনো জারি আছে। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তাঁদের প্রমাণ দিতে হচ্ছে—তাঁরা ভারতীয়, তাঁরা বিশ্বস্ত, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নন।

এই যুদ্ধ চালানো হচ্ছে অপবাদের মাধ্যমে, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মাধ্যমে, নীরবতা এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা দিয়ে। একজন নাগরিকের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার—সমানভাবে দেশের অংশ হওয়া—এখন মুসলমানদের জন্য শর্তসাপেক্ষ হয়ে উঠছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button