নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক কমল ২ শতাংশ

সংবাদপত্র শিল্পের জন্য একটি সুখবর নিয়ে এসেছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। দীর্ঘদিনের দাবির পর অবশেষে নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক ২ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত সোমবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশে বাজেট ঘোষণার সময় এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। একই দিনে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) এ-সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করে। এই পদক্ষেপ সংবাদপত্র শিল্পের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনলেও, শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরও কিছু দাবি পূরণ না হওয়ায় পুরোপুরি সুবিধা পাওয়া যায়নি।
শুল্ক কমানোর বিস্তারিত
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রকাশকদের পক্ষ থেকে আমদানি করা নিউজপ্রিন্ট কাগজের শুল্কহার এখন থেকে ৩ শতাংশ হবে। এর আগে এই শুল্কহার ছিল ৫ শতাংশ। তবে এই হ্রাসকৃত শুল্ক সুবিধা পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, শুল্কছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে শুধুমাত্র তথ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে নির্ধারিত বার্ষিক কোটার আওতায় আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের ক্ষেত্রে। এছাড়া, আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের প্রস্থ হতে হবে অনূর্ধ্ব ২৮ ইঞ্চি। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে শুল্কছাড়ের সুবিধা পাওয়া যাবে না।
এই শুল্ক হ্রাসের ফলে সংবাদপত্র শিল্পের উৎপাদন খরচ কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। নিউজপ্রিন্ট সংবাদপত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল, এবং এর আমদানি খরচ কমানোর ফলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আর্থিক চাপ কিছুটা হ্রাস পাবে। তবে, এই সুবিধার প্রকৃত প্রভাব বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শুল্ক কমানোর সুবিধা সবসময় ভোক্তা বা শিল্প পর্যায়ে পুরোপুরি পৌঁছায় না।
নোয়াবের দাবি ও প্রতিক্রিয়া
নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) দীর্ঘদিন ধরে নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিল। প্রাক্-বাজেট আলোচনায় নোয়াবের নেতারা তিনটি প্রধান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল: ১. নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা। ২. আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা। ৩. সংবাদপত্র শিল্পকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে করপোরেট কর অবলোপন বা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণ করা।
নোয়াবের প্রস্তাবের মধ্যে শুধুমাত্র প্রথমটি আংশিকভাবে গৃহীত হয়েছে। শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামানো হলেও, নোয়াবের প্রস্তাবিত ২ শতাংশের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। এছাড়া, ভ্যাট হ্রাস এবং করপোরেট কর অবলোপনের বিষয়ে বাজেটে কোনো ঘোষণা আসেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই দুটি বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা নোয়াব নেতাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে।
নোয়াবের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম শুল্ক আরও কমবে এবং অন্যান্য প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা হবে। শুল্ক কমানো একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এটি আমাদের সম্পূর্ণ দাবি পূরণ করেনি। ভ্যাট এবং করপোরেট করের বিষয়ে সরকারের নীরবতা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ।”
করপোরেট কর নিয়ে বিতর্ক
নোয়াবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংবাদপত্র শিল্পের ওপর বর্তমানে ২৭.৫ শতাংশ হারে করপোরেট কর আরোপ করা হয়, যেখানে অন্যান্য কিছু শিল্প খাতে এই হার ১২ শতাংশ। সংবাদপত্র শিল্পকে সেবামূলক শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে এই কর হার কমানোর দাবি জানানো হয়েছিল। নোয়াবের যুক্তি, সংবাদপত্র শিল্প শুধু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, এটি জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই এই শিল্পের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপ করা অযৌক্তিক। তারা প্রস্তাব করেছিলেন, করপোরেট কর পুরোপুরি অবলোপন করা হোক, অথবা এটি ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে নির্ধারণ করা হোক।
প্রাক্-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান নোয়াব নেতাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তারা শিল্পের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তিনি অগ্রিম কর এবং আগাম কর (এটি) কমানোর বিষয়েও কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাজেটে শুধুমাত্র নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক হ্রাসের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়েছে, অন্যান্য দাবিগুলো অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
সংবাদপত্র শিল্পের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্প বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি, মুদ্রণ ব্যয় বৃদ্ধি, এবং ডিজিটাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে এই শিল্পে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক কমানো এই শিল্পের জন্য কিছুটা স্বস্তি আনলেও, ভ্যাট এবং করপোরেট করের উচ্চ হারের কারণে আর্থিক চাপ কমেনি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুল্ক হ্রাসের সুবিধা যদি বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পৌঁছায়, তাহলে এটি সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়ক হবে। তবে, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শুল্ক হ্রাসের সুবিধা প্রায়শই বাজারের মধ্যস্থতাকারীদের কাছে চলে যায়, যার ফলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি সুবিধা পায় না।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পখাতের ভারসাম্য রক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই বাজেটে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে, যার মধ্যে নিউজপ্রিন্ট অন্যতম। তবে, অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শুল্ক হ্রাসের ফলে আমদানি পণ্যের প্রবাহ বাড়লে দেশীয় শিল্পগুলো প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। সংবাদপত্র শিল্পের ক্ষেত্রে এই প্রভাব সীমিত হলেও, ভ্যাট এবং করপোরেট করের বিষয়ে সরকারের নীতি এই শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
উপসংহার
নিউজপ্রিন্ট আমদানির শুল্ক ২ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত সংবাদপত্র শিল্পের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, এটি শিল্পের সব সমস্যার সমাধান নয়। নোয়াবের অন্যান্য দাবি, যেমন ভ্যাট হ্রাস এবং করপোরেট কর অবলোপন, পূরণ না হওয়ায় শিল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সরকার এবং এনবিআরের পক্ষ থেকে এই শিল্পের প্রতি আরও সহায়ক নীতি গ্রহণ করা হলে সংবাদপত্র শিল্প আরও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে। ভবিষ্যতে বাজার ব্যবস্থাপনা এবং নীতিগত সমন্বয় এই শুল্ক হ্রাসের সুফল পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।