ইরানে আদালত ভবনে সশস্ত্র হামলায় নিহত ৫, আহত ১৩

ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে একটি আদালত ভবনে সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের সশস্ত্র হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়েছেন। হামলাটি ইরানের জন্য নতুন করে নিরাপত্তাজনিত এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনা দেশের জনজীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নজর কাড়ছে।
হামলার সময় এবং ঘটনা বিবরণ
২০২৫ সালের ২৬ জুলাই শনিবার সকালে, সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী জাহেদানে অবস্থিত একটি আদালত ভবনে একযোগে সশস্ত্র সদস্যরা প্রবেশ করে। তারা সেখানে থাকা বিচারক ও আদালতের কর্মীদের ওপর হ্যান্ড গ্রেনেড ফেলে। এতে ৫ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে অন্তত একজন শিশু এবং একজন মা রয়েছেন। একই সাথে আহত হন আরও ১৩ জন।
স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তিন হামলাকারী নিহত হয়েছে বলে সরকারি সূত্র নিশ্চিত করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এখনো চলছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা চেষ্টা চলছে।
হামলার দায় স্বীকার করেছে জইশ আল-আদল
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে জইশ আল-আদল নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে সাধারণ মানুষদের এলাকা ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। এই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে সিস্তান-বেলুচিস্তানে সক্রিয় এবং বালুচ সংখ্যালঘুর অধিকার আদায়ের দাবিতে অস্ত্রধারী সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।
বালুচ মানবাধিকার সংগঠন হালভাশের বক্তব্য
স্থানীয় বালুচ মানবাধিকার সংগঠন হালভাশ জানিয়েছে, হামলাকারীরা বিচারকদের কক্ষে ঢুকে হামলা চালায়। এর ফলে আদালতের কর্মী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা হতাহত হয়। তারা উল্লেখ করেছে, এই হামলা সিস্তান-বেলুচিস্তানে বিদ্যমান দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনারই ফলাফল।
সিস্তান-বেলুচিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি
সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশটি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে প্রধানত সুন্নি বালুচ সংখ্যালঘু বসবাস করে। তারা বহু বছর ধরে অর্থনৈতিক অবহেলা ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ করে আসছে। ইরান সরকারের দৃষ্টিতে এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো দেশভিত্তিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
এই প্রদেশে নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিতই ঘটে থাকে। গোষ্ঠীগুলোর দাবি, তারা বালুচ জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন ও অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করছে। তবে ইরান সরকার বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীকে বিদেশি শক্তির সহযোগিতায় দেশবিরোধী কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
ইরানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ
সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে জটিল রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক এবং সামাজিক কারণ। সুন্নি বালুচ সংখ্যালঘুদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য এই অঞ্চলের উত্তেজনার মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে অবৈধ অস্ত্র পাচার ও মাদকের ব্যবসা ব্যাপক পরিমাণে চলে।
ইরান সরকার এ সব সমস্যার মোকাবেলায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু সেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা কমে না। এই কারণে প্রদেশটি ইরানের অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেকটাই অস্থিতিশীল।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং প্রতিবেশী দেশের প্রভাব
সিস্তান-বেলুচিস্তানের অবস্থা শুধু ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; এটি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের বালুচ গোষ্ঠীগুলোও একই জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আন্তর্জাতিক সীমান্তে অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে থাকে। ইরান সরকারের অভিযোগ, কিছু বিদেশি শক্তি এ অঞ্চল থেকে ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যা নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
বালুচ জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং অর্থনৈতিক অবস্থা
বালুচ জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে ইরান সরকারের নীতি ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অবহেলার শিকার। তারা দাবি করে, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অধিকার যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না। সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। উন্নয়নমূলক কাজ খুবই কম, শিক্ষার সুযোগ সীমিত এবং চাকরির বাজার দুর্বল।
এই অবস্থা বালুচ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বাড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ।
সাম্প্রতিক ঘটনা এবং ভবিষ্যতের প্রভাব
এই হামলা ইরানের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইরানি কর্তৃপক্ষের কাছে এটি একটি বড় নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জ, যেখানে তারা তাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন ইরানের এই প্রদেশের দিকে। তারা আশা করে, ইরান শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করবে এবং সিস্তান-বেলুচিস্তানে মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে আদালত ভবনে হামলার ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন ও আহত হয়েছে আরও তেরো জন। এই হামলা শুধু একটি নিরাপত্তাজনিত ঘটনা নয়, বরং এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন। ইরান সরকারের জন্য এই সংকট মোকাবেলা করা সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে সুন্নি বালুচ সংখ্যালঘুর অধিকার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরি।
আসন্ন দিনে ইরানকে প্রয়োজন হবে আরও কার্যকর নীতি, জনগণের সাথে সংলাপ এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করার। না হলে সিস্তান-বেলুচিস্তানের মতো সীমান্তবর্তী অঞ্চল ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে থাকতে পারে।