অর্থনীতি

পাইকারি বিদ্যুতের দামে সমতা চায় ডেসকো-ওজোপাডিকো

পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে সমতা আনার জন্য আবেদন জানিয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। এই দুই বিতরণ কোম্পানি সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর কাছে আবেদন করে, অন্য বিতরণ কোম্পানির তুলনায় ৩৩ কেভি লাইনে তাদের প্রদেয় বেশি মূল্য কমিয়ে সমান করার দাবি জানিয়েছে। তবে বিইআরসি স্পষ্ট জানিয়েছে, গণশুনানি ছাড়া পাইকারি বিদ্যুতের দামে কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগ নেই।

আবেদনের পটভূমি

ডেসকো, যারা ঢাকা শহরের উত্তরাংশ এবং টঙ্গী এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে, তারা ঢাকার অপর বিতরণ কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)-র সমান পাইকারি মূল্যহার নির্ধারণের জন্য বিইআরসি’র কাছে চিঠি দিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওজোপাডিকো, রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণকারী নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)-র সমান মূল্যহার চেয়ে আবেদন করেছে।

বর্তমানে, ৩৩ কেভি লাইনে ডিপিডিসির তুলনায় ডেসকোকে ইউনিটপ্রতি প্রায় ৩ পয়সা বেশি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডিপিডিসি এই লাইনে ইউনিটপ্রতি ৮.৫৬ টাকা হারে বিল দিচ্ছে, যেখানে ডেসকোর বিল ইউনিটপ্রতি ৮.৫৮৮০ টাকা। একইভাবে, ওজোপাডিকোকে নেসকোর তুলনায় ইউনিটপ্রতি ৪২ পয়সা বেশি বিল দিতে হচ্ছে। নেসকো ৩৩ কেভি লাইনে ইউনিটপ্রতি ৭.০৪ টাকা হারে বিল পরিশোধ করলেও, ওজোপাডিকোর বিল ইউনিটপ্রতি ৭.৪৬ টাকা।

বিদ্যুৎ বিতরণের প্রক্রিয়া

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সরকারি ও বেসরকারি উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি হারে বিক্রি করে। এই বিতরণ কোম্পানিগুলো পরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বর্তমানে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো, নেসকো, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (বিপিডিবি)।

পার্থক্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বিইআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে পাইকারি বিদ্যুতের দরে এই পার্থক্য বিদ্যমান। সে সময় কোম্পানিগুলোর রাজস্ব চাহিদা এবং গ্রাহক সংখ্যার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ডিপিডিসির রাজস্ব আয় তখন কম থাকায় তাদের ৩৩ কেভি লাইনের পাইকারি দাম ডেসকোর তুলনায় কম নির্ধারণ করা হয়। একইভাবে, নতুন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি হিসেবে নেসকোকে স্বনির্ভর করার জন্য তাদের পাইকারি দাম কম রাখা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও, ৩৩ কেভি লাইনের এই পার্থক্য অপরিবর্তিত থেকে যায়।

লোকসানের চিত্র

ডেসকো এবং ওজোপাডিকো তাদের আবেদনে জানিয়েছে, বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের কারণে তারা উল্লেখযোগ্য আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। গত অর্থবছরে ডেসকো ৫০৫ কোটি টাকা এবং ওজোপাডিকো ২০.email protected] কোটি টাকা নিট লোকসান বহন করেছে। ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ হায়দার বলেন, “নেসকো এবং আমাদের গ্রাহকের মান একই হলেও, ৩৩ কেভি লাইনে আমাদের পাইকারি দর বেশি। এটি আমাদের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।”

বিইআরসির অবস্থান

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ডেসকো এবং ওজোপাডিকোর আবেদনের বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিইআরসি জানিয়েছে, পাইকারি বিদ্যুতের দামে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে অবশ্যই গণশুনানির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটি বিইআরসি আইন, ২০০৩-এর অধীনে একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। গণশুনানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামত নেওয়া হয় এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়।

বিইআরসি’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ডেসকো এবং ওজোপাডিকোর আবেদন আমরা পেয়েছি। তবে এই ধরনের মূল্য সমন্বয়ের জন্য গণশুনানি আয়োজন করতে হবে। এটি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।”

গণশুনানির তাৎপর্য

গণশুনানি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে মূল্য নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত বিইআরসি আয়োজন করে, যেখানে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি, গ্রাহক প্রতিনিধি, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয় এবং জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা করা হয়।

তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণশুনানির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে বিইআরসি আইন সংশোধনের পর সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে। এটি গণশুনানির গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস করেছে বলে সমালোচকরা মনে করেন।

সম্ভাব্য প্রভাব

ডেসকো এবং ওজোপাডিকোর আবেদন গৃহীত হলে এটি তাদের আর্থিক চাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে। তবে, বিদ্যুৎ খাতের সামগ্রিক ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যের উপর এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘাটতির মুখোমুখি, এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর ঘাটতি ছিল ৩৯,৫৩৪ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে পাইকারি মূল্য কমানো পিডিবির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

অন্যদিকে, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রবণতা ইতোমধ্যে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতিবিদ এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে উৎপাদন খরচ কমানো এবং দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button