যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি আটকে যাওয়ায় দেশীয় বাজারে ছাড়ে বিক্রি করছে চীনা রপ্তানিকারকেরা

চীনা পণ্য আমদানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের কারণে থমকে গেছে বিশাল রপ্তানি বাজার। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া শুল্কনীতির ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চীনের রপ্তানিকারকেরা। এই পরিস্থিতিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৈরি পণ্য দেশীয় বাজারে বড় ছাড়ে বিক্রি করতে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ চীন এখন অভ্যন্তরীণ বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য: বিশাল দেশীয় ভোক্তা বাজার। রয়টার্স-এর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—চীনের রপ্তানিকারকেরা স্থানীয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম Red Note-এর মাধ্যমে দেশীয় ক্রেতাদের কাছে রপ্তানি-প্রস্তুত পণ্য কম দামে বিক্রি করছেন।
মার্কিন বাজারে প্রবেশে বাধা, লাইভ স্ট্রিমে বিক্রির চেষ্টা
চীনের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া Red Note-এ রপ্তানিকারকেরা লাইভ স্ট্রিমের মাধ্যমে রীতিমতো অনলাইনে পণ্যের হাট বসিয়েছেন। লাঞ্চবক্স, জুসার, রাইস কুকার, টোস্টার, ব্র্যান্ডেড মগসহ নানা ধরনের পণ্য একাধিক বিক্রেতা সরাসরি সম্প্রচারে দেখিয়ে বলছেন—এই পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের ১৪৫% শুল্ক আরোপ ও নতুন সীমাবদ্ধতার কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এসব পণ্য এখন বড় ডিসকাউন্টে বিক্রি করা হচ্ছে চীনের সাধারণ ভোক্তাদের কাছে।
একজন বিক্রেতা, যিনি নিজেকে ‘ডিংডিং ক্লাউড ফরেন ট্রেড ওয়্যারহাউস’ হিসেবে পরিচয় দেন, লাইভ স্ট্রিমে বলেন,
“আমেরিকা চুক্তি ভেঙে দিয়েছে। আর কোনো পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না! সবকিছু ৯০ শতাংশ ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে!”
আরেক বিক্রেতা ‘মুজি হ্যাজ গুড গুডস’, তাঁর স্টুডিওতে ‘ট্রেড ট্রানজিট কনটেইনার’ লেখা বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন,
“আমরা আর আমেরিকায় পণ্য পাঠাতে পারছি না। গুদাম ভর্তি হয়ে গেছে।”
ব্র্যান্ডেড ও অচেনা পণ্যের মিশ্রতা
এ ধরনের বিক্রিতে যেমন পরিচিত ব্র্যান্ড যেমন কস্টা কফির মগ পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি এমন অনেক অচেনা ব্র্যান্ডও রয়েছে, যেগুলোর নাম বিদেশি ক্রেতারা খুব একটা শোনেননি। যেমন—ওএসটিএমএআরএস ও এপিএলএক্স, যেগুলো সাধারণত অ্যামাজনের মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের টার্গেট করে তৈরি করা হয়।
সরকার ও ই-কমার্স জায়ান্টদের সহায়তা
চীনা সরকার এই সংকটে রপ্তানিকারকদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সরকারিভাবে ঘোষণা এসেছে—দেশীয় বাজারে রপ্তানিযোগ্য পণ্য বিক্রি করতে উৎসাহ দেওয়া হবে। চীনের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন রিটেইলার জেডিডটকম (JD.com) ঘোষণা দিয়েছে, তারা আগামী এক বছরে ২০০ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ২৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের তহবিল গঠন করবে রপ্তানিকারকদের দেশীয় বিক্রিতে সহায়তার জন্য।
এছাড়া আলিবাবার মালিকানাধীন সুপারমার্কেট চেইন ফ্রেশিপ্পো (Freshippo) এবং অন্যান্য বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মও এই প্রচারণায় যুক্ত হয়েছে।
ক্যান্টন ফেয়ারে রপ্তানিকারকদের হতাশা
চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গুয়াংজুতে অনুষ্ঠিত ক্যান্টন ফেয়ার হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য মেলা। সেখানে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চীনের একাধিক রপ্তানিকারক বলেন,
“আমাদের জন্য মার্কিন বাজার এখন কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় টিকে থাকতে দেশীয় বাজারই ভরসা।”
ভিন্ন মত: নিছক মার্কেটিং?
তবে বিষয়টি নিয়ে রপ্তানি খাতের কিছু অভিজ্ঞ ব্যক্তি ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এই লাইভ স্ট্রিম আসলে এক ধরনের মার্কেটিং কৌশল। চীনের এক রপ্তানিকারক রয়টার্সকে বলেন,
“সাধারণত রপ্তানিকারকদের একাধিক গন্তব্য থাকে। মার্কিন বাজার বন্ধ হলে তারা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকায় পাঠাতে পারেন।”
রয়টার্সের সাংবাদিকরা Red Note-এ প্রচারণা চালানো ১২ জন বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, তবে কেউ সাড়া দেননি।
বিশ্লেষকের অভিমত: এটা চীনের প্রতিরোধ মনোভাব
চোজান নামের একটি ডিজিটাল কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাশলি ডুদারেনোক বলেন,
“এই লাইভ স্ট্রিমগুলো চীনের ভোক্তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করছে। এটা শুধু বাণিজ্যিক ব্যাপার নয়, বরং দেশের সম্মানের ব্যাপার হয়ে উঠছে।”
তিনি আরও বলেন,
“ট্রাম্পের শুল্কনীতি চীনের মানুষের মধ্যে দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে। এখন হ্যাশট্যাগ হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে—‘চীন পারবে’, ‘কারখানা বাঁচাও’, ‘প্রতিরোধ করো’। এই মনোভাব চীনা অর্থনীতিকে দীর্ঘমেয়াদে আরও আত্মনির্ভর করে তুলতে পারে।”
- যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৫% শুল্ক আরোপে চীনা রপ্তানি থমকে গেছে
- রপ্তানিকারকেরা Red Note-এ লাইভ স্ট্রিমে দেশীয়ভাবে পণ্য বিক্রি করছেন
- পণ্যে ৯০% পর্যন্ত ছাড়, জনপ্রিয় ও অচেনা ব্র্যান্ড মিশ্র পণ্য
- চীনা সরকার ও ই-কমার্স জায়ান্টদের সহায়তা
- মার্কিন বাজারকে কার্যত ‘বন্ধ’ বলছে ব্যবসায়ীরা
- কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এটি জাতীয়তাবাদী মার্কেটিং
- জনমনে তৈরি হচ্ছে ‘দেশীয় পণ্য কিনুন’ মনোভাব