জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধের প্রস্তাব

যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের বাজেট অফিস (ওএমবি) সম্প্রতি একটি প্রস্তাব পেশ করেছে, যেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন পুরোপুরি বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। রয়টার্সের হাতে আসা অভ্যন্তরীণ নথির বরাত দিয়ে জানা যায়, মালি, লেবানন ও কঙ্গোর মতো দেশগুলোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে এই তহবিল বন্ধের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। বিশেষত যেসব অঞ্চল যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সঙ্কটে রয়েছে, সেসব এলাকায় মানবিক বিপর্যয় বাড়তে পারে।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমানে জাতিসংঘের নিয়মিত বাজেট প্রায় ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ২২ শতাংশ অর্থ জোগান দেয় যুক্তরাষ্ট্র। শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য নির্ধারিত ৫৬০ কোটি ডলার বাজেটের ২৭ শতাংশ-ই আসে ওয়াশিংটনের পকেট থেকে। অর্থাৎ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সবচেয়ে বেশি এবং তা বাধ্যতামূলক।
যদি এই প্রস্তাব বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে জাতিসংঘের কার্যক্রমে বড় ধরনের অর্থসংকট দেখা দেবে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় মোট ৯টি শান্তিরক্ষা মিশন চালু আছে, যার মধ্যে রয়েছে মালি, লেবানন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, পশ্চিম সাহারা, সাইপ্রাস, কসোভো, সিরিয়া ও ইসরায়েলের গোলান মালভূমি এবং সুদান-দক্ষিণ সুদানের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল আবিয়েতে পরিচালিত মিশনগুলো।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
ওএমবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মালি, লেবানন ও কঙ্গোর শান্তিরক্ষা মিশন ‘ব্যর্থ’ হয়েছে এবং উচ্চ ব্যয় সত্ত্বেও এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। এই কারণ দেখিয়েই সিআইপিএ (Contributions for International Peacekeeping Activities)-এর জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের ‘পাসব্যাক’ নীতির অংশ হিসেবে এসেছে, যার মূল লক্ষ্য হল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং দেশের স্বার্থকে আগে রাখা।
এ প্রসঙ্গে এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “মিনুসমা, ইউএনআইএফআইএল, ও মনুসকো-সহ একাধিক শান্তিরক্ষা মিশনের ফলাফল হতাশাজনক। ফলে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাজেট থেকে এই খাতটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।”
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। সংস্থার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেছেন, বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
তবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বলেছেন, জাতিসংঘ তার ৮০ বছর পূর্তির সময় একটি তীব্র তহবিল সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রধান দাতাদের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে অনেক কার্যক্রম স্থগিত হতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের কাছে ১৫০ কোটি ডলার নিয়মিত বাজেটের ও ১২০ কোটি ডলার শান্তিরক্ষার অর্থ বকেয়া রেখেছে। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনো দেশ দুই বছরের মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করে, তবে তারা সাধারণ পরিষদে ভোটাধিকার হারাতে পারে।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির নতুন সংস্করণ
ওএমবি প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘের তহবিল কাটা হলেও একটি নতুন প্রকল্প, ‘আমেরিকা ফার্স্ট অপরচুনিটি ফান্ড (A1OF)’, চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর আওতায় বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২১০ কোটি ডলারের তহবিল বরাদ্দ করা হবে। অর্থাৎ জাতিসংঘকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের মত অনুযায়ী বৈদেশিক সাহায্য বণ্টন করতে চায়।
কংগ্রেসের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
তবে এই বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট কার্যকর হতে হলে তা কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন। এর আগে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম মেয়াদে শান্তিরক্ষা বাজেট কমানোর প্রস্তাব দিলেও কংগ্রেস তা বাতিল করেছিল। এবারের ক্ষেত্রেও কংগ্রেস সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব ও আশঙ্কা
বিশ্লেষকদের মতে, যদি যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা তহবিল থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে তা বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে, সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ বাড়তে পারে এবং বহু দেশ নতুন করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অর্থায়ন বন্ধের প্রস্তাব একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক ও মানবিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। যদিও এটি এখনো কংগ্রেসে অনুমোদনের অপেক্ষায়, তবু বিষয়টি বিশ্ব রাজনীতিতে আলোড়ন তুলেছে। সামনে কী ঘটবে, তা নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপ্রবাহ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের ওপর।