জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আগ্রহ নেই মানুষের, জানালো জাতিসংঘ

জাতিসংঘ — বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান সংগঠন। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার মূল লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার রক্ষা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের কার্যক্রম নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে, গাজা সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক সংকটে সংস্থার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
২০২৫ সালে ৮০ বছরে পা দিলেও, জাতিসংঘ আজকালের বাস্তবতায় তার প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্বীকার করেছেন, মানুষের মধ্যে তাদের রিপোর্টের প্রতি আগ্রহের অভাব রয়েছে।
জাতিসংঘের বর্তমান অবস্থা:
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন মোট ২৭ হাজার বৈঠক করেছে। এর মধ্যেও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাদের রিপোর্ট ও কার্যক্রমে আগ্রহ খুবই কম। গুতেরেসের মতে, অতিরিক্ত বৈঠক ও রিপোর্টিং সিস্টেম জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে এবং কার্যক্ষমতা কমাচ্ছে।
তাঁর বক্তব্য, “গত বছর আমাদের ২৪০টি সংগঠন একসঙ্গে প্রায় ২৭ হাজার বৈঠক করেছে। আমাদের সচিবালয় ১,১০০-এর বেশি রিপোর্ট তৈরি করেছে, কিন্তু এগুলো পড়া হয় না, অর্থাৎ আমরা আমাদের ম্যান্ডেট পূরণে ব্যর্থ হচ্ছি।”
মানবতাবিরোধী সংঘাত ও জাতিসংঘের ভূমিকা:
গাজায় ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুটি বড় সংকটে জাতিসংঘ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গুতেরেস নিজেও স্বীকার করেছেন, “আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারিনি। এর জন্য সংস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি।”
জাতিসংঘের আর্থিক সংকট ও সংস্কার:
সাত বছর ধরে সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিয়মিত বকেয়া পরিশোধ না করার ফলে জাতিসংঘের আর্থিক অবস্থা সংকটাপন্ন। এই পরিস্থিতিতে মহাসচিব গুতেরেস মার্চ ২০২৫ সালে ‘UN80 টাস্কফোর্স’ চালু করেন। এই টাস্কফোর্সের লক্ষ্য হলো সংস্থার খরচ কমানো এবং কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়ানো।
তিনি বলেন, “আমরা কম সভা ও কম প্রতিবেদনের মাধ্যমে কাজ করার পরিকল্পনা করছি, যাতে সংস্থা আরও কার্যকরভাবে পরিচালিত হতে পারে।”
রিপোর্ট ডাউনলোড ও পাঠকদের আগ্রহ:
জাতিসংঘের প্রতিবেদনগুলো ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু গুতেরেসের রিপোর্ট অনুযায়ী, শীর্ষ ৫টি রিপোর্টই মাত্র ৫,৫০০ বার ডাউনলোড হয়েছে। এর পাশাপাশি, পাঁচটির মধ্যে একটি রিপোর্ট মাত্র এক হাজারের কম ডাউনলোড পেয়েছে। এই তথ্য স্পষ্ট করে দেয় যে, সাধারণ জনগণের মধ্যে জাতিসংঘের রিপোর্টের প্রতি আগ্রহ নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ আজকের বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা ছাড়া টিকে থাকতে পারবে না। অনেকের মতে, সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্যদের আধিপত্য থাকা আরেক বড় সমস্যা, যা সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
সংগঠনের ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা:
জাতিসংঘের ৮০তম বার্ষিকী সামনে রেখে সংস্কার এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। মহাসচিব গুতেরেসের পরিকল্পনা হলো একটি আধুনিক, দক্ষ ও সময়োপযোগী সংস্থা গঠন করা, যাতে বৈঠক ও প্রতিবেদন সংখ্যা কমানো হয়, কিন্তু কার্যকারিতা বাড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের সংস্কার ছাড়া ভবিষ্যতে এটি তার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হবে, যা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তির জন্য এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে, এটি জনসাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না এবং কার্যকারিতায় সংকটে আছে।
গুতেরেসের নেতৃত্বে জাতিসংঘ যে সংস্কার পরিকল্পনা নিয়েছে, তা দ্রুত এবং সফলভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায়, ৮০ বছর পরেও সংস্থাটি তার কাঙ্খিত ভূমিকা পালন করতে পারবে না।
MAH – 12100 , Signalbd.com