ভাগাড়ে ঠাঁই আলুর, কান্নায় ভাসছে কৃষক

এক সময় যেটি ছিল স্বপ্নের ফসল, আজ তা যেন দুঃস্বপ্ন। ঠাকুরগাঁওয়ে আলুর বাম্পার ফলন হলেও হিমাগার সংকট ও বাজারে চাহিদা কম থাকায় কৃষকরা পড়েছেন মারাত্মক বিপাকে। খোলা জায়গায় ফেলে রাখতে গিয়ে পচে যাচ্ছে টনকে টন আলু, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, আর কৃষকদের চোখে শুধুই হতাশা।
ভালো ফলনের পরও মুখ থুবড়ে পড়ল কৃষকের আশা
ঠাকুরগাঁও জেলার ঢোলারহাট, হরিপুর, বেগুনবাড়ি, নারগুনসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের মাঠে, রাস্তার পাশে এমনকি খাল-বিলে পড়ে রয়েছে পচা আলুর স্তূপ। দুর্গন্ধে আশপাশের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। কৃষকদের সেই স্বপ্নের ফসল আজ হয়ে উঠেছে ‘অবাঞ্ছিত বোঝা’।
ঢোলারহাট ইউনিয়নের কৃষক আবদুল হাকিম এক সময়ের আলুভর্তি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন। তিনি বলেন,
“এই আলু ছিল আমার স্বপ্ন, এই আলুই আজ আমার সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
উৎপাদন ৮.৫ লাখ টন, হিমাগারে স্থান মাত্র ১.৫ লাখ টন!
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৫ সালে ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার টন। অথচ পুরো জেলায় হিমাগারের সংখ্যা মাত্র ১৭টি, যেগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টন।
অর্থাৎ, সাড়ে ছয় লাখ টন আলু সংরক্ষণের কোনো সুযোগ নেই। এই বিপুল পরিমাণ আলু খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে পচে যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংরক্ষণেও ব্যর্থতা
আঁকচা ইউনিয়নের কৃষক লুৎফর রহমান জানান,
“৫০০ মণ আলু ছিল। হিমাগারে জায়গা পাইনি। নিজে টিনের ঘর তুলে রাখলাম। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। এখন ২০০ মণের বেশি আলু পচে গেছে।”
নারগুন ইউনিয়নের আমিনুল ইসলাম বলেন,
“দেড় একর জমিতে আলু লাগিয়ে ২ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকাও উঠছে না। ঋণের চাপে ঘুম হারাম।”
হরিপুরের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন,
“হিমাগার না পেয়ে বারান্দা, রান্নাঘর, এমনকি ঘরের নিচেও আলু রেখেছিলাম। এখন চারদিক থেকে দুর্গন্ধ আসছে। বুঝতে পারছি—সব শেষ।”
সরকারি রপ্তানি উদ্যোগ নেই, বাজারও চুপচাপ
আলু ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম বলছেন,
“আগে রাশিয়া, নেপাল, মালয়েশিয়া, ভুটানে আলু রপ্তানি হতো। তখন কৃষক কিছুটা লাভের মুখ দেখত। এবার সরকার কোনো রপ্তানির ব্যবস্থা নেয়নি, তাই লোকসান নিশ্চিত।”
ফলস্বরূপ স্থানীয় বাজারে আলুর চাহিদা কম, দাম পড়ে গেছে তলানিতে। খরচের তুলনায় বিক্রির মূল্য অনেক কম হওয়ায় কৃষকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
কৃষি বিভাগের দায় এড়াতে ব্যর্থতা নিয়ে বিতর্ক
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাজেদুল ইসলাম বলেন,
“চাষিরা উঠানে পর্যন্ত আলু লাগিয়েছেন। আমরা আগেই পরামর্শ দিয়েছিলাম কম উৎপাদনের জন্য। কিন্তু তারা কথা শোনেননি।”
এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বেগুনবাড়ির কৃষক আবদুল হাকিম। তিনি বলেন,
“চাষ না করলে খাব কী? সরকার যদি হিমাগার বাড়াত না, রপ্তানির উদ্যোগ নিত, তাহলে কি আমরা এভাবে পথে বসতাম?”
অর্থনৈতিক প্রভাব ও সামাজিক সংকট
এই বিপর্যয়ের প্রভাব শুধু কৃষকের আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন একটি সামাজিক সংকটে পরিণত হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম এখন ঋণের চাপে নুইয়ে পড়েছে। দোকানিদের কাছে বাকি, ব্যাংকের ঋণ—সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার যদি আগেভাগেই উৎপাদনের পূর্বাভাস বিশ্লেষণ করে বাজার ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি ও হিমাগার সম্প্রসারণে কাজ করত, তাহলে এই সংকট এড়ানো যেত।
সমাধানের পথ কী?
বিশ্লেষক ও কৃষি উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন:
- হিমাগার সংখ্যা বাড়াতে হবে সরকারিভাবে ও বেসরকারি বিনিয়োগে।
- আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
- কৃষি তথ্যসেবা কার্যকর করতে হবে, যাতে চাষিরা আগেই জানতে পারে বাজার পরিস্থিতি।
- প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ কার্যক্রম চালু করতে হবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য।
আলুর ভাগ্যে কী আছে?
একটি ফসল কৃষকের ভাগ্য বদলে দিতে পারে আবার সর্বনাশও ডেকে আনতে পারে—ঠাকুরগাঁওয়ের আলুর পরিস্থিতি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। আলুর ভাগ্যে কী আছে তা হয়তো ভবিষ্যত বলবে, কিন্তু এখন কৃষকের ভাগ্যে শুধুই হতাশা, দুর্গন্ধ আর পচে যাওয়া স্বপ্ন।